বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লক্ষী পদ দাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেন
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছেন বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লক্ষী পদ দাশ। দীর্ঘ পাঁচ মাসের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর অবশেষে তিনি হাইকোর্ট থেকে চার মামলায় জামিন পান। বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে বান্দরবান জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন।
জেল সুপার মো. আনোয়ারুল করিম সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “গত ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট লক্ষী পদ দাশকে জামিন দেন। কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বুধবার সকালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।”
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বড় রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। বান্দরবানেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই সময় বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতারা একযোগে লক্ষী পদ দাশের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করেন।
এই মামলাগুলোর মধ্যে চারটিতে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেও একটি মামলা এখনো চলমান রয়েছে। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন নাশকতা, সহিংসতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে তার নাম জড়িত করা হয়।
মামলা দায়েরের পরপরই লক্ষী পদ দাশ বান্দরবান ত্যাগ করে ঢাকায় চলে যান। প্রায় সাত মাস তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ কেরানীগঞ্জে বিশেষ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে বান্দরবান চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়।
আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। এরপর থেকেই তিনি বান্দরবান জেলা কারাগারে বন্দি ছিলেন।
আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট তার চার মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন। প্রায় এক সপ্তাহ পর জামিনের কাগজপত্র জেলা কারাগারে পৌঁছালে বুধবার সকালে তিনি মুক্তি পান।
এই মুক্তির পর রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
বান্দরবান একটি সংবেদনশীল এলাকা। এখানে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, স্থানীয় সংগঠন এবং পাহাড়ি ছাত্র ও নাগরিক সংগঠন সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে।
লক্ষী পদ দাশ দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি একাধিকবার সংগঠনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে তার গ্রেপ্তার ও কারাবাস স্থানীয় রাজনৈতিক সমীকরণে বড় পরিবর্তন এনেছিল।
লক্ষী পদ দাশের মুক্তিকে কেন্দ্র করে বান্দরবানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বিষয়টিকে স্বস্তি হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, সংগঠন এখন নতুন করে গতিশীল হবে।
এক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বলেন,
“আমরা আশা করি তার মুক্তির পর জেলা আওয়ামী লীগ আবার সক্রিয় হবে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছিল।”
অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এই জামিন ‘রাজনৈতিক প্রভাবের ফসল’। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামিন পাওয়া মানেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া নয়। এখনো মামলাগুলো চলমান। তবে হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয় যে, তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার মতো পর্যাপ্ত ভিত্তি ছিল না।
একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মন্তব্য করেন,
“জামিন হলো অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার। আদালত মামলার প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে যদি মনে করেন অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া যায়, তবে এটি আইনসম্মত। এখন মূল বিচার প্রক্রিয়াই প্রমাণ করবে তিনি আসলেই দোষী কিনা।”
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান ঘটে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাখো মানুষ রাস্তায় নামে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
৫ আগস্টের ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা ও সংঘর্ষ দেখা দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দায়ী করে। এই সময় বান্দরবানে একাধিক মামলার সূত্রপাত হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল লক্ষী পদ দাশের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা।
লক্ষী পদ দাশ মুক্তি পাওয়ায় বান্দরবানের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। আওয়ামী লীগ এখন তাকে ঘিরে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চাইবে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এর বিরোধিতা করবে এবং মামলার বিষয়গুলো সামনে আনবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে বান্দরবান আবারো আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসবে।
লক্ষী পদ দাশের মুক্তি শুধু একটি আইনি ঘটনা নয়, এটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বান্দরবানের রাজনীতি সবসময়ই সংবেদনশীল এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
আটক, মামলা ও জামিন—সব মিলিয়ে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারো স্পষ্ট হলো, বাংলাদেশে রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থা কতটা আন্তঃসম্পর্কিত।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। তবে লক্ষী পদ দাশের মুক্তি স্থানীয় আওয়ামী লীগে নতুন উদ্দীপনা জোগাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।