ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার হাসানের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, অস্ত্র ও মাদক মামলায় আসামিদের রক্ষায় প্রভাব খাটানো, রাজনৈতিক দখলদারিত্বে সহায়তা এবং সাধারণ মানুষের হয়রানিসহ নানা অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে ওসির অপসারণ দাবিতে অন্তত ১০ বার মানববন্ধন ও থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে মোহাম্মদপুরবাসী।
সেনা অভিযানে আটক, কিন্তু বাদ গেল মূল আসামি
গত বছরের নভেম্বরে মোহাম্মদপুর থানাধীন বুড়িগঙ্গা পাম্পে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ দুইজনকে আটক করে। আটককৃতদের ম্যানেজারের কক্ষ থেকে পাওয়া যায় একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলি। সেনাসদস্যরা পাম্প মালিক শামিম বেপারিকে প্রধান আসামি করে মামলা করতে থানাকে নির্দেশ দিলেও ওসি ইফতেখার হাসান সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে ফোন করে জানান, ঘটনাস্থলে পাওয়া না যাওয়ায় শামিমকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পরে মূল আসামিকে বাদ দিয়েই মামলা করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, মামলার মূল আসামির নাম বাদ দিতে শামিম বেপারির কাছ থেকে অন্তত ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন ওসি। আটক দুজনকে রিমান্ডে না এনে দ্রুত জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়।
থানা হয়ে উঠেছে ‘ঘুষের কারখানা’, অভিযোগে জর্জরিত মোহাম্মদপুর থানা
স্থানীয়দের অভিযোগ, এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং মোহাম্মদপুর থানায় প্রতিদিন এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটে চলছে। জব্দ করা হেরোইনের মামলার নথি গায়েব, বাসা থেকে ডেকে এনে মাদক মামলায় ফাঁসানো, টাকা না দিলে মামলা নথিভুক্ত না করা, কিংবা ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া—এসব অভিযোগে জর্জরিত স্থানীয় প্রশাসন।
জানাগেছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের পরিবার থেকে রিমান্ডে এনে ৩০ লাখ টাকা আদায়, জেনেভা ক্যাম্পের চিহ্নিত মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ এবং সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে আঁতাত করে ইচ্ছামতো পুলিশ কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে ওসি ইফতেখারের বিরুদ্ধে।
একটি ঘটনার উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে, কিশোর গ্যাংবিরোধী সফল অভিযানের পর সাবেক এসআই মাসুম ও তার টিমকে পরিকল্পিতভাবে ‘মব অ্যাটাকে’ ফেলে বদলি করে দেন ওসি, যা ছিল একটি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক দখল ও পুলিশের সহযোগিতা
বুড়িগঙ্গা পাম্প দখল করে রেখেছেন শামিম বেপারি, যার ভাই শাসকদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সেনা অভিযানে পাওয়া অস্ত্রধারী দুই ব্যক্তিকে পাম্প পাহারায় নিয়োগ দিয়েছিলেন শামিম, যাতে কেউ পাম্প দখল করতে না পারে। অথচ ওসির সহযোগিতায় সেই শামিম আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অন্যদিকে, সিলিকন সিটির এমডি সারোয়ার খালিদকে গ্রেপ্তার করে ৫০ লাখ টাকা আদায়ের পর তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। বছিলা গার্ডেন সিটির শামীম কোম্পানিকে আটকের পরিবর্তে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওপেন সিক্রেট হয়ে উঠেছে ওসির ঘুষ বাণিজ্য
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ওসি ইফতেখারের ঘুষ বাণিজ্য এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। থানা পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মন্টুকে আটকের পর ১৬ লাখ টাকা নিয়ে কোর্টে চালান করা হয়, যদিও মামলাটি ছিল একটি সাধারণ মারামারির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেনাক্যাম্পের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা অস্ত্রসহ আটক করে থানায় হস্তান্তর করেছি এবং শামিম বেপারিকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু ওসি জানান, ঘটনাস্থলে না থাকায় তাকে আসামি করা যাবে না। আমরা তখন আর কিছু বলিনি। এখন ইন্টেলিজেন্স দিয়ে তাকে খুঁজছি।’’
ডিএমপি বলছে তদন্তাধীন
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান বলেন, “ওসি ইফতেখারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমানকে হঠাৎ ক্লোজ করে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওসির কাছের ডিএমপির একজন অতিরিক্ত কমিশনারের নির্দেশেই কোনো তদন্ত ছাড়াই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ওসির বক্তব্য
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘‘একজন ওসির সঙ্গে কথা বলেছি, যিনি এখানে দেড় বছর ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৫০টি তদন্ত হয়েছিল। আমি তাকে বললাম, তাহলে তো আমি ভালো আছি। আমার বিরুদ্ধে ৬ মাসে মাত্র ৩০টি তদন্ত হচ্ছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এই জায়গাটাই খারাপ। এখানে কোনো ওসি বেশিদিন থাকতে পারেন না। এটা আমার সমস্যা না।’’