শুল্ক ফাঁকি দিয়ে জিরা, রেডবুল ও ফুসকা ঢাকায় পাঠানোর চেষ্টা ভেস্তে দিল হাইওয়ে পুলিশ
বাংলাদেশে ঈদুল আজহা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি একটি বড় অর্থনৈতিক গতিবিধির উপলক্ষ্যও বটে। পশুর হাট, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক এবং নানা রকম প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায় এই সময়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে একটি চিহ্নিত অসাধু চক্র—চোরাকারবারিরা। যখন বৈধ পথে আমদানি কার্যত বন্ধ থাকে, তখনই তাদের অপতৎপরতা বাড়ে কয়েকগুণ। সম্প্রতি মৌলভীবাজারে এমনই একটি ঘটনা ঘটে যা দেশের পণ্য বাজার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বর্তমানে ভারতীয় পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে বৈধ পথে আমদানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক বিভিন্ন কারণে ভারতের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানি সীমিত পর্যায়ে চলে এসেছে। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারিরা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে মালামাল দেশে ঢুকিয়ে চলেছে।
বিশেষ করে ঈদুল আজহার আগে বাজারে যে পরিমাণ মসলা, খাদ্য ও পানীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ে, তা পূরণ করতে এই চোরাকারবারিরা বেছে নেয় সহজ কিন্তু অবৈধ পথ—চোরাচালান।
গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর হাইওয়ে থানার টহল পুলিশ একটি বড় অভিযানের মাধ্যমে একটি চোরাই ট্রাক আটক করে। ট্রাকটিতে ছিল:
- ১২৫ বস্তা জিরা (৩৭৫০ কেজি)
- ৪,৩২০টি রেডবুল এনার্জি ড্রিংক
- ৫২০ প্যাকেট ফুসকা (প্রতিটি এক কেজি করে)
উদ্ধারকৃত এসব পণ্যের মোট আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা। এসব পণ্য অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল।
এই ঘটনায় ট্রাকচালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করেছে হাইওয়ে পুলিশ। তাঁদের নাম:
- রতন আলী (২৩) – চালক, সলঙ্গা, সিরাজগঞ্জ
- আরিফুল ইসলাম (৩০) – হেলপার, সলঙ্গা, সিরাজগঞ্জ
তাঁদের বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই দু’জন অনেক দিন ধরেই চোরাকারবারিদের হয়ে পরিবহন কাজ করে আসছিলেন।
ট্রাক আটক করার পর চালক একটি নিলাম চালান দেখায়, যা নাকি সুনামগঞ্জের বড়ছড়া শুল্ক স্টেশনের গুদাম ইনচার্জ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছিল। কিন্তু পুলিশ কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয় যে এটি একটি জাল ও ভুয়া চালান। মূলত এই চালান দেখিয়ে ট্রাকটি বৈধ পণ্য পরিবহনের ভান করছিল, যা সাধারণত কাস্টমস পণ্য পরিবহনের সময় ব্যবহৃত হয়।
এই গোটা অভিযানে নেতৃত্ব দেন হাইওয়ে পুলিশের সিলেট রিজিওনের সহকারী পুলিশ সুপার মির্জা সাইজ উদ্দিন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন:
- শেরপুর হাইওয়ে থানার ওসি আবু তাহের দেওয়ান
- হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট সম্রাট হোসেন
- এসআই সৈয়দ ইমরুল সাহেদ
- শিশির চন্দ্র দাশ এবং অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা
তাঁদের সমন্বিত তৎপরতায় রাতের আঁধারে এই বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য আটকে দেওয়া সম্ভব হয়।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক বেশি। স্থানীয় প্রশাসন এবং হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত টহলের মাধ্যমে চোরাকারবারিদের রুট শনাক্ত করে তাদের তৎপরতা দমন করার চেষ্টা করছে। তবে এটি একটি চলমান লড়াই।
সূত্র জানায়, ট্রাকটি সিলেটের একটি সীমান্ত এলাকা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। এ পথে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা ছিল তাদের গন্তব্য। এই চোরাকারবারি নেটওয়ার্ক শুধু সীমান্তেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের ভেতরে থাকা বহু অসাধু ব্যবসায়ী, পরিবহনকর্মী, এমনকি কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঈদুল আজহার সময় মসলাজাতীয় পণ্যের যেমন জিরা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গের চাহিদা বেড়ে যায়। পাশাপাশি পানীয় পণ্য, যেমন রেডবুল, হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিক্রয়যোগ্য। এসব পণ্যের ওপর যখন উচ্চ শুল্ক আরোপ থাকে বা বৈধ আমদানি বন্ধ থাকে, তখন চোরাইপথে এসব পণ্য এনে বাজারে ফেলে দেয়া হয়।
এর ফলে দেশি পণ্যের চাহিদা হ্রাস পায়, সরকারি রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাজারে মূল্যহীন ও স্বাস্থ্যহানিকর চোরাই পণ্য ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোরাইপথে আমদানি করা জিনিসের মান ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থাকে না। যেমন, জিরা ও ফুসকার মতো খাদ্যপণ্য যদি যথাযথ তাপমাত্রায় সংরক্ষিত না হয় বা প্রক্রিয়াজাত না হয়, তাহলে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
এছাড়া রেডবুল জাতীয় এনার্জি ড্রিংকে অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও চিনির উপস্থিতি থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। অবৈধভাবে আমদানি করা এসব পণ্যে ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না।
চোরাচালান শুধু আইন পরিপন্থী নয়, বরং জাতীয় রাজস্ব আয়ের অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক। বৈধ পথে আমদানি করলে যে পরিমাণ শুল্ক, ভ্যাট ও ট্যাক্স সরকার পায়, চোরাকারবারিরা তা ফাঁকি দিয়ে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় হাজার কোটি টাকার চোরাচালান হয়ে থাকে, যার অধিকাংশই ঘটে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে।
বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনিক মহল থেকে চোরাচালান প্রতিরোধে যে সুপারিশগুলো এসেছে তা হলো:
- সীমান্ত এলাকায় স্মার্ট স্ক্যানিং টাওয়ার স্থাপন
- কাস্টমস ও বিজিবি’র সমন্বিত তথ্য আদান-প্রদান
- উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি
- চালকদের ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু
- সাধারণ জনগণকে সচেতন করে ‘ক্রেতা’ হিসেবে ভূমিকা রাখা
এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত দ্রুতগতিতে চলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চোরাই মাল পরিবহনের নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর নামও পাওয়া গেছে, যাদের গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে।
মৌলভীবাজারে চোরাই ট্রাকসহ পণ্য আটকের ঘটনা আমাদের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে—দেশে চোরাচালান একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ, যা কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রতিরোধের বিষয়।
ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের সময় এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং ন্যায্য বাজার ব্যবস্থার ওপরও আঘাত হানে। প্রশাসনের সক্রিয়তা অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে চোরাকারবারি দমনে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ও প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ জরুরি।