শাহবাগে চলমান অবস্থান কর্মসূচি আরও জোরদার, জুলাইয়ে বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ার ঘোষণা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের উত্তাল দিন ফেরাচ্ছে শাহবাগ চত্বর। দেশের কেন্দ্রস্থলে শুক্রবার (৯ মে) রাতে আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের হুঁশিয়ারির মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, “দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত না এলে ফের ‘মার্চ টু ঢাকা’-র মতো সর্বাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।”
নাহিদ ইসলাম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এই ঘোষণা দেন। শাহবাগে অবস্থানরত হাজার হাজার আন্দোলনকারী এবং দেশের নানা প্রান্তে এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানো জনগণ তার বক্তব্যে নতুন উদ্দীপনা পেয়েছে। এই হুঁশিয়ারি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নয়, এটি দেশের চলমান শাসনব্যবস্থার ওপর এক জোরালো প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।
বিকেল ৪টা ৪০ মিনিট থেকে শাহবাগ মোড়ে জনতার ঢল নামে। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের উপস্থিতিতে শাহবাগ হয়ে ওঠে এক অনন্য প্রতিরোধের মঞ্চ। ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, গান, কবিতা এবং প্রতিবাদী স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। এই আন্দোলনের মূল দাবি: “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করো, গণতন্ত্র রক্ষা করো।”
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “ইন্টেরিম সরকারের কানে আমাদের দাবি পৌঁছায়নি। তাই আমরা শাহবাগ অবরোধ করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান চলবে।”
এনসিপির আহ্বায়কের বক্তব্যে স্পষ্ট বার্তা
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী লীগ ও দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে জুলাই মাসে সকল বাংলাদেশপন্থি শক্তি একত্রিত হবে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যেই ব্লকেড চালু হয়েছে। দ্রুত সময়ে সিদ্ধান্ত না এলে ফের সমগ্র বাংলাদেশ ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করবে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, ইসলামবিরোধী, নারীবিরোধী, মানবতা বিরোধী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী মুজিববাদী সংগঠন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য এখনই সকল জাতীয় শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: শাহবাগ এবং গণআন্দোলন
শাহবাগ একাধারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি প্রতীকী স্থান। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে শুরু করে প্রতিটি যুগান্তকারী আন্দোলনে শাহবাগ হয়েছে প্রথম প্রতিরোধের ব্যারিকেড। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই আন্দোলন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও সুসংগঠিত এবং ধারালো।
ছাত্র, নারী, প্রবীণ, শিশু—সবাই এই প্রতিরোধে শামিল। দিনরাত অবস্থান চলছে। কেউ মাইকে বলছেন, কেউ পথনাটক পরিবেশন করছেন। শাহবাগ এখন যেন একটি বিপ্লবের শহর। যেখানে লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে আর স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে:
“বাঁচার অধিকার চাই, ফ্যাসিবাদ হঠাও। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো।”
আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল:
১. নির্বাচনী ব্যবস্থার ধ্বংস
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। ‘ভোটাধিকার রক্ষা কমিটি’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে বলা হয়েছে, “ভোট ছাড়া সরকার মানি না, স্বৈরাচার হটাতে হবে।”
২. মানবাধিকার লঙ্ঘন
গুম, খুন, বেআইনি আটক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
৩. রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন
বড় বড় মেগা প্রকল্পের আড়ালে দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর প্রকল্প, মেট্রোরেলসহ একাধিক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে।
সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশের সার্বভৌমত্ব বা সংবিধানের পরিপন্থী কোনো দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা যায়। তবে এর জন্য আদালতের অনুমতি প্রয়োজন। আন্দোলনকারীদের দাবি—আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে সংবিধান ও গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। তাই আদালতের মাধ্যমে দলটি নিষিদ্ধ করাই হবে আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব।
বিএনপি সরাসরি এই আন্দোলনের নেতৃত্বে না থাকলেও দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা শাহবাগে গিয়েছেন এবং আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “শাহবাগে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সূচনা।”
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান চাই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি যৌক্তিক।”
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ড. জাফর ইকবাল, সুলতানা কামাল প্রমুখ বিশিষ্ট নাগরিক আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তারা বলছেন, “রাজনীতি যদি গণবিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে জনগণেরই দায়িত্ব হয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা।”
শাহবাগ আন্দোলনকারীরা ইতোমধ্যে তাদের অবস্থান কর্মসূচিকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন:
- অবস্থান ও প্রচার পর্ব: যেখানে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হবে।
- সারাদেশে ব্লকেড: ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ অবরোধ করে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
- মার্চ টু ঢাকা – ২.০: যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না আসে, তবে সমগ্র দেশের মানুষ ঢাকামুখী পদযাত্রায় অংশ নেবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই আন্দোলনের ওপর নজর রাখছে। তারা সকল পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, “আন্তর্জাতিক চাপ নয়, অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধই প্রকৃত সমাধান।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি শুধু একটি দল নয়, একটি রাষ্ট্রচিন্তার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো কী হবে? বিকল্প রাজনীতির জন্য প্রস্তুত কি বাংলাদেশ?
নাহিদ ইসলাম ও শাহবাগের আন্দোলনকারীদের মতে, “এটাই সময়। না হলে আর কখনো নয়।”
সুতরাং, আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির গতিপথ কোন দিকে মোড় নেবে, তা নির্ধারণ করবে এই শাহবাগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, সাংগঠনিক শক্তি এবং জনসম্পৃক্ততা। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়—বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের মতো থাকছে না।