নির্বাচিত সরকারই পারে টেকসই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে: আমীর খসরু
চট্টগ্রামের কাজীর দেউরী ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এক ব্যতিক্রমী সেমিনারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ‘তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই সেমিনারে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বিভাগের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অতিথিদের সরব উপস্থিতি প্রমাণ করে—বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতিকে নতুন চোখে দেখছে এবং তারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে।
সেমিনারের মূল বক্তা হিসেবে আমীর খসরু তার বক্তব্যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগের প্রকৃত অবস্থা ও তরুণদের রাজনৈতিক জাগরণ প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা এখন ‘বিনিয়োগের সার্কাস’ দেখছি। যারা প্রকৃত বিনিয়োগ বোঝে, তারা জানে যে এই অবস্থায় বিনিয়োগ সম্ভব না। একটি জবাবদিহিমূলক, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা অসম্ভব।”
আলোচনায় তিনি যে বিষয়টি বারবার উচ্চারণ করেন তা হলো—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা অপরিহার্য। তার ভাষায়, “আমাদের দেশে এখনো এমন কোনো সরকার গঠিত হয়নি, যাকে বলা যায় প্রকৃত অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত। জনগণের কাছে যিনি জবাবদিহি করেন, বারবার ভোটের মুখোমুখি হন, তিনিই প্রকৃত জনপ্রতিনিধি।”
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি অনৈক্যপূর্ণ ও বিতর্কিত নির্বাচন প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তরুণদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান, তারা যেন রাজনীতির প্রতি উদাসীন না হয়ে বরং এ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় হয়।
আমীর খসরু স্পষ্টভাবে বলেন, “কোনো দেশে বিনিয়োগ হবে তখনই, যখন রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকবে। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। এটি আত্মকর্মসংস্থানই হোক বা কর্পোরেট চাকরি—উভয়ের ভিত্তি হলো বিনিয়োগ।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে বর্তমানে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আস্থা রাখতে পারছে না, ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, এবং তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে তরুণ প্রজন্মের জীবনে।
বক্তব্যে তিনি তিনটি মৌলিক শিক্ষার কথা তুলে ধরেন, যা এই সেমিনার থেকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করা যায় বলে তিনি মনে করেন।
তার ভাষায়, “সম্বোধনের পালা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কেউ কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডেকে সময় অপচয় করেনি। রাজনীতিতে এখন কাজ, পরিকল্পনা ও বাস্তবতার জায়গায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে, আচার-অনুষ্ঠানে নয়।”
তিনি বলেন, “এই ফোরামে অনেকেই উপস্থিত আছেন যারা বিএনপি করেন না, তবুও তারা এখানে এসে বক্তব্য রাখছেন। এটি একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় পরিবর্তন। একে উদার গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিফলন হিসেবে দেখা উচিত।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সামনে নেতারা বসে থাকলেও কেউ বক্তৃতা দেননি। এটি বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আমরা আলোচনা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, নেতৃত্ব কেন্দ্রীক নয়।”
তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের জনগণের মনোজগতে একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটবে। যারা এই পরিবর্তন অনুধাবন করতে পারবে না, তারা রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবে না।” তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, “এখনই সময় প্রস্তুতির। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সামাজিক উদ্যোগ—সব কিছুতেই প্রস্তুত থাকতে হবে।”
এই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন দেশের এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, যারা তারুণ্যের ভবিষ্যৎ, প্রযুক্তি ও সমাজ নিয়ে বিশদভাবে আলোকপাত করেন।
- ড. ওমর ফারুক ইউছুপ (চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) বলেন, “আমরা এখন এমন একটি সময়ে বাস করছি যেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি একসঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। তরুণরা চাইলে এই প্রতিকূলতাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে পারে।”
- সাঈদ আল নোমান (ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডার) বলেন, “দেশে এখন কনটেন্ট ইকোনমি গড়ে উঠছে। শুধু রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ডিজিটাল অর্থনীতিতেও তারুণ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
- সাইয়েদ আবদুল্লাহ (কনটেন্ট ক্রিয়েটর) বলেন, “তরুণরা এখন একাধিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের মত প্রকাশ করছে। এটি গণতন্ত্র চর্চার বিকল্প উপায় হয়ে উঠছে।”
- ফাহিম আহমেদ (পাঠাও সিইও) বলেন, “নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রয়োজন সহায়ক পরিবেশ। সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতকে একসাথে কাজ করতে হবে।”
সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। উপস্থাপনায় ছিলেন তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন। সমগ্র অনুষ্ঠান ছিল সুশৃঙ্খল, পরিকল্পিত এবং অংশগ্রহণমূলক। এতে উপস্থিত শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা ও রাজনৈতিক কর্মীরা একমত হন যে তরুণদের ভবিষ্যৎ গঠনে নীতি ও পরিবেশ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই অনুষ্ঠানটি নিছক এক দিনের সেমিনার ছিল না, বরং এটি ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে তরুণদের প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত। যারা এতদিন রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারা এখন আলোচনা করতে চায়, পরিকল্পনা করতে চায় এবং ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখতে চায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি সময়োপযোগী বার্তা—তারা যদি তরুণদের চাহিদা, ভাবনা ও উদ্দীপনা বুঝতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে টিকে থাকাই হবে তাদের জন্য কঠিন।