ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে এপ্রিল ২০২৫-এ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো—২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণে ঐতিহাসিক উত্থান। সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, এপ্রিল মাসে দেশে মোট ২৭৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) প্রায় ৩৩ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকার সমান। এ হিসাব অনুযায়ী, মাসটিতে প্রতিদিন গড়ে এসেছে প্রায় ৯ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এটি দেশের ইতিহাসে একক মাস হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ।
এই রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রমাণ করে যে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় এখনো দেশের অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে রয়েছে। এই প্রবণতা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর আগের মাস অর্থাৎ মার্চ ২০২৫-এ দেশে সর্বোচ্চ ৩২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। সেই রেকর্ড গড়ার ঠিক পরের মাসেই এপ্রিলের এই প্রবৃদ্ধি রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারাবাহিক ইতিবাচক প্রবণতা নির্দেশ করে।
এপ্রিলে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৩৪.৬০ শতাংশ বেশি। গত বছর এপ্রিল মাসে দেশে এসেছিল ২০৪ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। এই বৃদ্ধি শুধু সংখ্যা নয়, বরং রেমিট্যান্স প্রেরণের প্রক্রিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজারের ইতিবাচক পরিস্থিতি এবং সরকারের বিভিন্ন নীতি-উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের প্রতিফলনও বটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, এই ১০ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে বছর ব্যবধানে ২৮.৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই তথ্য বলছে, দেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠী বৈদেশিক আয় প্রেরণে আগের তুলনায় বেশি সক্রিয় এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ প্রচেষ্টা, বৈধ চ্যানেলের ব্যবহার বৃদ্ধি, হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনার মতো উৎসাহব্যঞ্জক ব্যবস্থাগুলো রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, যা অনেক প্রবাসীকে বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স সংক্রান্ত বিভাগগুলোর সক্রিয় তদারকি ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমবাজারে চাহিদা বৃদ্ধিও এই পরিমাণ বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু মাস ধরেই আলোচনা চলছিল। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসের শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন উচ্চ প্রবাহ অব্যাহত থাকলে আমদানি ব্যয় পরিশোধ, ঋণ পরিশোধ ও মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, মে মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক থাকতে পারে, কারণ ঈদুল আজহার আগে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ বেড়ে থাকে।
দেশে বিগত কয়েক মাস ধরে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট, আমদানি ব্যয় পরিশোধে বিলম্ব এবং হুন্ডির প্রভাব—সব মিলিয়ে বাজারে অস্থিরতা ছিল। তবে মার্চ ও এপ্রিলের শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ পরিস্থিতিকে কিছুটা স্থিতিশীল করেছে। সরকারি সংস্থাগুলোও আশা করছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে এবং বিনিময় হারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে জটিলতার প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অন্যতম প্রধান ভরসার জায়গা। এই অর্থ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, ভোক্তা ব্যয়, নির্মাণ খাত, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি প্রবাসীদের প্রশিক্ষণ, নিরাপদ অভিবাসন, বিদেশে কর্মসংস্থানের বহুমুখীকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধাজনক প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নে জোর দেয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে রেমিট্যান্স ৪০০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, কুয়েত ও ওমান বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রধান অবদান রাখছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই এপ্রিল মাসে এসেছে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স।
এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকেও সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে রেমিট্যান্স আসছে, যা বাংলাদেশের অভিবাসন বৈচিত্র্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ, নারী কর্মীদের নিরাপদ প্রেরণ ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রবাহ আরও বাড়ানো সম্ভব।
যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহে বর্তমানে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও সামনে রয়েছে। হুন্ডি ব্যবসা এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীরা অনেক সময় নানা প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক জটিলতার সম্মুখীন হন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই প্রযুক্তি, কার্যকর প্রশাসন এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।
এপ্রিল মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি আশার সঞ্চার করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রবাসীদের প্রতি সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহায়তা থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এ উৎসকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। সামনের দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অনেক সহজ হবে।