এবার আগেভাগেই বই ছাপার কাজ শুরু করছে এনসিটিবি
এ বছর বিনা মূল্যে বিতরণযোগ্য পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে উল্লেখযোগ্য দেরি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রায় তিন মাস পর, অর্থাৎ মার্চের শেষ দিকে, সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য সব বিষয়ের বই সরবরাহ করতে সক্ষম হয় সংস্থাটি। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা নিয়ে শিক্ষা খাতে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রস্তুতি হিসেবে এবার আগেভাগেই বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু করছে এনসিটিবি। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহেই নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে এবং জুনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করে মাঠপর্যায়ে তা বিতরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বর্তমানে এনসিটিবির নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় সংস্থার সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানিয়েছেন, “গতবারের বাজে অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে এবার আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, যাতে আগামী বছরের প্রথম দিন থেকেই শিক্ষার্থীরা বই হাতে পায়।”
২০১০ সাল থেকে দেশে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন বই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই নানা জটিলতায় সময়মতো সব শিক্ষার্থীকে পূর্ণাঙ্গ বই সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, কারণ সর্বশেষ বই সরবরাহের অনুমোদন (পিডিআই) দেওয়া হয় মার্চের ২৪ তারিখে।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত অ্যানুয়াল প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান (এপিপি) অনুযায়ী মাঠপর্যায় থেকে পাঠ্যবইয়ের চাহিদা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৩ কোটি ১২ লাখ বইয়ের চাহিদা পাওয়া গেলেও যাচাই-বাছাই শেষে তা কমে ২২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা আরও কমতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে এবার এখনো বইয়ের চাহিদা নির্ধারণ হয়নি। তবে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে এই সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগে বিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত চাহিদা দিত, ফলে সরকারের ব্যয়ও বেড়ে যেত। এবার এনসিটিবির কর্মকর্তারা নিজেরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে চাহিদা যাচাই করছেন, যাতে যথাযথ হিসাব নিশ্চিত হয়।
সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে প্রাক-প্রাথমিক ও ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জুনের মধ্যে সব শ্রেণির বইয়ের দরপত্রের কাজ শেষ করা হবে। এরপর:
- ২৫ অক্টোবরের মধ্যে: প্রাথমিক স্তরের বই ছাপিয়ে দেশের ৫৮৫টি বিতরণ কেন্দ্রে পাঠানো হবে।
- মধ্য নভেম্বরের মধ্যে: মাধ্যমিক স্তরের সব বই বিতরণ সম্পন্ন হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, চলতি শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করতেই সময় চলে গিয়েছিল ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, যা বই বিতরণে উল্লেখযোগ্য দেরির একটি কারণ।
গত বছর পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠদান চালু ছিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা থাকলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে মাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করা হয় এবং ২০১২ সালের পুরনো শিক্ষাক্রম পুনরায় কার্যকর করা হয়।
প্রাথমিক স্তরে যদিও কার্যত নতুন শিক্ষাক্রমই বহাল রয়েছে এবং আগামী বছর সেই শিক্ষাক্রম অনুসারেই পাঠ্যবই ছাপা হবে। এনসিটিবি জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিদ্যমান পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজও প্রায় শেষের পথে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২৭ সাল থেকে পুরো শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই পরিবর্তন শুরু হতে পারে এবং এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী জানিয়েছেন, “আমরা এখন থেকেই শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের প্রাথমিক কিছু কাজ শুরু করছি। তবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।”
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চলতি বছরের শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবই সরবরাহে ব্যর্থতার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যে ভোগান্তির কারণ হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বই ছাপা, দরপত্র আহ্বান, সরবরাহ এবং শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে সময়মতো উদ্যোগ গ্রহণ করলে আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারিতেই নতুন বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ২০২৭ সাল থেকে একটি আধুনিক, সময়োপযোগী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।