সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনা
সম্প্রতি সিরিয়া সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মার্লিন স্টুটজম্যান। দীর্ঘ এক দশকের গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে সিরিয়া। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল সারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়েছেন—তবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তসহ।
জেরুজালেম পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন কংগ্রেসম্যান স্টুটজম্যান বলেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে আগ্রহী। তবে আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি দেশটির “পূর্ণ অখণ্ডতা” রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, যতক্ষণ না সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা স্বীকৃতি পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো চুক্তি সম্ভব নয়।
সিরিয়া দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, ইসরায়েল গোলান উপত্যকা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট সারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে ইচ্ছুক হলেও তিনি স্পষ্ট করেছেন—যদি ইসরায়েল সিরিয়ার ভূখণ্ডে আরও কোনো সামরিক আক্রমণ চালায়, তবে সম্পর্কোন্নয়নের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এই বক্তব্যে স্পষ্ট, সিরিয়া এখন আর প্রতিক্রিয়াশীল নীতিতে নয়, বরং কৌশলগত চিন্তায় চলতে চায়।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন আহমেদ আল সারা। এই পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে। স্টুটজম্যানের সফর ছিল সেই নতুন যুগের সূচনা বলেই অনেকে মনে করছেন।
কংগ্রেসম্যানের ভাষায়, সিরিয়ার জনগণ দেশটিকে আবারও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদার আসনে দেখতে চায়। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি তাদের সম্মান ও আস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি দেখেছি সিরিয়ার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়।”
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সমঝোতা বা সমর্থনের ঘোষণা আসেনি, তবুও স্টুটজম্যান ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, যদি সিরিয়া মানবাধিকার, নারীর অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে পারে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ইতিবাচক পথে এগোয়, তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে আরও জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রতিনিধি দল সিরিয়া সফরে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অতীতের যুদ্ধঘনিষ্ঠ ইতিহাস। যদিও ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ এর আওতায় আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর মতো দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, সিরিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন।
প্রথমত, সিরিয়ার অভ্যন্তরে এখনও বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া ও ইরানের মতো শক্তিধর মিত্ররা সিরিয়ার কূটনৈতিক পথচলায় প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ সহজ নয়।
গোলান উপত্যকা ইস্যু আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত। জাতিসংঘ এখনও এটিকে সিরিয়ার অংশ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়। প্রেসিডেন্ট সারা এই ইস্যুকে সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্ক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত ভারসাম্য বদলাচ্ছে। সৌদি আরব-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া, ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের কিছু দেশের কূটনৈতিক অগ্রগতি এবং চীনের মধ্যস্থতায় আঞ্চলিক সমঝোতা—সব মিলিয়ে এখন নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যেই সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন।
যদিও পরিস্থিতি জটিল এবং বহু শর্তসাপেক্ষ, তবে সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার আগ্রহ মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন শান্তির বার্তা বয়ে আনতে পারে। এ প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উভয় পক্ষের আন্তরিকতা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং সর্বোপরি জনগণের কল্যাণে একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি।
বিশ্ব এখন পর্যবেক্ষণ করছে—আহমেদ আল সারা ও তার নেতৃত্বাধীন সিরিয়া কি পারবে নতুন করে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—ইসরায়েল ও সিরিয়া কি এক টেবিলে বসে শান্তির নতুন অধ্যায় লিখবে?