প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ ১০ হাজার মানুষের
প্রতি বছরের মার্চ থেকে জুন—এই তিন মাস যেন টমেটোর জন্য উৎসবমুখর হয়ে ওঠে দিনাজপুরের গাবুড়া এলাকা। পূর্ব ভোর থেকেই জমে ওঠে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই টমেটো বাজারটি। প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত সড়কের দুই পাশজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য ভ্যানগাড়ি, পিকআপ, ট্রাক ও হোন্ডা। মানুষের কোলাহল, দরদামের হাঁকডাক আর যানবাহনের হর্ন মিলিয়ে এক জমজমাট পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সকাল ৯টার মধ্যেই লেনদেন শেষ হয়ে যায়, তারপর চলে লোড-আনলোডের ধকল। গড় হিসেবে প্রতিদিন ১.৫ থেকে ২ কোটি টাকার টমেটো কেনাবেচা হয় এ বাজারে।
এই প্রতিবেদনটি গাবুড়া বাজারকে ঘিরে গড়ে ওঠা কৃষিপণ্য বাণিজ্য, কৃষকের জীবনমান পরিবর্তন, কর্মসংস্থান এবং সম্ভাবনার এক পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে।
টমেটোর এ বিশাল বাজারের যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দিনাজপুর সদর উপজেলার গর্ভেশ্বরী নদীর তীরে এই বাজারের সূচনা ঘটে। প্রথমদিকে স্থানীয় কৃষকেরা টমেটোর পাশাপাশি তরমুজ চাষ করতেন। আবদুল বাতেন নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জের এক বন্ধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে টমেটো পাঠাতে শুরু করলে ধীরে ধীরে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
একসময় শিলাবৃষ্টিতে তরমুজের ক্ষতির পর স্থানীয় কৃষকেরা টমেটো আবাদে মনোযোগী হন। কারণ এর বাজার ছিল দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা এক লাভজনক ক্ষেত্র। এভাবেই গাবুড়া বাজার পরিচিতি পায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারদের কাছে।
প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই গাবুড়া বাজারে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত ভ্যান, প্রতিটি ভ্যানে দুই থেকে চারটি করে বড় ঝুড়ি ভর্তি টমেটো। এই ঝুড়ির মধ্যে বিভিন্ন জাতের টমেটো দেখা যায়—বিপুল প্লাস, প্রভেনসিভ, রোমা ভিএফ, মিন্টু সুপার, আনসাল, রানী ও শক্তি প্লাস। কেউ গোলাকার, কেউ বা লম্বাকৃতি।
পাইকাররা হাত দিয়ে টমেটো নাড়িয়ে দেখে, দামে মিললে সেই ঝুড়ি নিয়ে যায় নিজ নিজ আড়তে। সেখান থেকে তা ক্যারেটে ভরে উঠিয়ে দেওয়া হয় ট্রাকে। একটি ট্রাকে গড়ে ৫৬০ ক্যারেট পর্যন্ত টমেটো লোড করা হয়, যার ওজন প্রায় ১৪ হাজার কেজি বা ৩৫০ মণ।
প্রতিদিন গড়ে ৯০ থেকে ১০০টি ট্রাক গাবুড়া থেকে রওনা দেয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দিনে গড় লেনদেন দাঁড়ায় সাড়ে ৩১ হাজার মণ টমেটোর, যার আর্থিক পরিমাণ দেড় কোটি টাকারও বেশি।
গাবুড়া টমেটো বাজার শুধু কৃষিপণ্য বিক্রির স্থানই নয়, এটি একটি মৌসুমি কর্মসংস্থানের বড় উৎসও বটে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে এখানে কাজ পান ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ।
ট্রাকশ্রমিক, লোডার, আড়তদার, দোকানদার, খাবারের হোটেল কর্মী, ঝুড়ি প্রস্তুতকারী, পরিবহন শ্রমিক—সবাই মিলিয়ে একটি প্রানবন্ত অর্থনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। আশপাশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরাও মৌসুমে কাজ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পান।
দিনাজপুর, চিরিরবন্দর ও বীরগঞ্জ এলাকার বহু কৃষক এখন টমেটো চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। যাঁরা একসময় বর্গা জমিতে চাষ করতেন, এখন তাঁরা নিজস্ব জমির মালিক। কেউ তুলেছেন পাকা বাড়ি, কেউ বা গরুর খামার দিয়েছেন।
একজন চাষি আবদুর রশিদ জানান, ‘প্রতি বিঘায় খরচ পড়ে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। লাভ হয় কিনা তা নির্ভর করে বাজারদরের ওপর। ভালো বছর হলে বিঘাপ্রতি এক লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।’ তবে তিনি খাজনা ও অতিরিক্ত ধলতা (৩ কেজি প্রতি মণ) নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, এটি কমানো উচিত।
২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শরীয়তপুর থেকে গাবুড়ায় আসছেন চান মিয়া খালাসী। তিনি বলেন, ‘এখানকার টমেটোর মান ভালো। চাষিদের সঙ্গে সম্পর্কও ভালো। আগে থেকেই চাষিরা আমাদের জানিয়ে দেন কখন ফসল তোলা হবে।’
এই সম্পর্কের ভিত্তিতে অনেক পাইকার চাষিদের আগেই টাকা দিয়ে রাখেন। ফলে আস্থা ও বাণিজ্যিক স্বচ্ছতা—দুই-ই গড়ে ওঠে।
একসময় যেখানে মাত্র ৫-৬টি দোকান ছিল, এখন সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে ৪৫০টিরও বেশি দোকান। গোপালপুর, রাজারামপুর ও মস্তানবাজারে ভাড়া বাড়ি, গুদামঘর আর ট্রান্সপোর্ট ব্যবসাও গড়ে উঠেছে।
আগে পাইকাররা শহরে থাকতেন, এখন বাজারসংলগ্ন এলাকায়ই বাড়িভাড়া নিয়ে মৌসুমকালীন বসবাস করেন। একেকটি কক্ষের ভাড়া ২০-২৫ হাজার টাকায় উঠেছে, যা থেকে বাড়ির মালিকরাও আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
টমেটো চাষের এই ক্রমবর্ধমান প্রসার নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও রয়েছে তৎপর। অতিরিক্ত উপপরিচালক আনিছুজ্জামান বলেন, ‘এখনকার কৃষকেরা অনেক সচেতন ও স্মার্ট। কৃষি বিভাগ নতুন জাত যেমন “শক্তি প্লাস” নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে।’
গত বছর যেখানে টমেটো চাষ হয়েছিল ৯২৫ হেক্টর জমিতে, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৫৭৮ হেক্টরে। চাষ বাড়ছে সদর ও চিরিরবন্দর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি।
সরকারি উদ্যোগে গাবুড়া এলাকায় একটি হিমাগার নির্মাণ কাজও শেষের পথে। এটি চালু হলে কৃষক টমেটো সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং মৌসুম ছাড়া সময়েও ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন।
বিশাল বাজারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মূল্য ওঠানামা ও সংরক্ষণের অভাব। একেক বছরে লাভ, আবার কোনো বছরে লোকসান—এমন চক্রে কৃষকেরা পড়েন অনিশ্চয়তায়।
বাজারে এখনো টমেটোর দর নির্ধারণে কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। পাইকার ও আড়তদারের কথাতেই মূলত দর স্থির হয়। অনেক সময় কৃষকের পক্ষে দরদাম করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
গাবুড়া বাজার যদি পরিকল্পিতভাবে আধুনিক রূপ পায়, তবে এটি দেশের অন্যতম কৃষিপণ্য রপ্তানি হাবে পরিণত হতে পারে। হিমাগার, মান নিয়ন্ত্রণ, সরকারি দর নির্ধারণ কমিটি, অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করা গেলে কৃষকেরা আরও স্বস্তি পাবেন।
গাবুড়া এখন আর শুধুমাত্র দিনাজপুরের একটি গ্রামীণ বাজার নয়, এটি হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষি অর্থনীতির কেন্দ্র। শত শত পরিবার এখানে নির্ভর করছে টমেটোর ব্যবসার ওপর। কৃষকের ঘাম, শ্রম ও অভিজ্ঞতা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী কৃষি-ভিত্তিক ইকোসিস্টেম।
সরকারি সহযোগিতা, আধুনিক ব্যবস্থাপনা, ন্যায্য মূল্য এবং পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে গাবুড়াকে কেন্দ্র করে দেশের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।