উত্তর আমেরিকার মানচিত্রে ম্যাচিয়াস সিল দ্বীপ ছোট্ট একটি বিন্দুর মতো হলেও এর গুরুত্ব অনেক। জনবসতিহীন, কুয়াশাচ্ছন্ন এই পাথুরে দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে বিরল এক সীমান্ত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দ্বীপটি ‘গ্রে জোন’ নামে পরিচিত একটি বিতর্কিত এলাকায় পড়েছে, যার মালিকানা দাবি করে উভয় দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন এবং কানাডার নিউ ব্রান্সউইক প্রদেশের সংযোগস্থলে থাকা এই দ্বীপ ও এর আশপাশের জলসীমা মূলত মূল্যবান গলদা চিংড়ির কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকায় মাছ ধরতে গিয়ে মার্কিন ও কানাডীয় জেলেদের মধ্যে প্রায়ই সংঘাত বেধে যায়, যার ফলে দুর্ঘটনায় আঘাত ও ক্ষতির ঘটনাও ঘটে।
প্রায় ৩০ বছর ধরে এই এলাকায় মাছ ধরছেন জন ড্রাইউন নামে এক মার্কিন জেলে। তাঁর ভাষ্যমতে, শিকারের মৌসুমে আগে কে ফাঁদ বসাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে যায় যে, জেলে বা জালের দড়িতে হাত আটকে অনেকে আঘাত পান, কেউ কেউ অঙ্গ হারান।
এই বিতর্কিত এলাকা ১৭০০-এর দশক থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৮৪ সালে একটি আন্তর্জাতিক আদালত উভয় দেশকে এখানে মাছ ধরার অনুমতি দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে এই সীমান্ত বিরোধের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে। তিনি প্রকাশ্যে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের “৫১তম রাজ্য” করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে কানাডার পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন ও প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন পানি ও খনিজ সম্পদ নিয়ে মতপ্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্পের মতে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকা সীমান্ত একটি “কৃত্রিম রেখা”, যার কোনো মানে নেই। আবার কানাডার প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, ট্রাম্প কৌশলে কানাডাকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এমন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে—বিশ্বের দায়িত্ব না নিয়ে বরং উত্তর আমেরিকাকেই নিজেদের ‘দুর্গ’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—ট্রাম্প কি পরিকল্পনা করেই এমন কাজ করছেন, নাকি এগুলো কেবল তাৎক্ষণিক বেফাঁস মন্তব্য? সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন মনে করেন, ট্রাম্পের চিন্তাগুলো পরিকল্পনাহীন, ধারাবাহিকতা নেই, বরং ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আগ্রহ বেশি।
যাই হোক, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্কের মধ্যে যে আস্থার ভিত্তি ছিল, তা ভেঙে পড়ছে। কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি একীভূত করার চেষ্টা করা হয়, তবে তারা সেটার কড়া প্রতিবাদ করবেন।
একসময় ইতিহাসের অংশ হিসেবে থাকা কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত নিয়ে বিরোধ এখন আবার নতুন করে সামনে এসেছে, এবং কোথায় গিয়ে এই উত্তেজনা থামবে—তা এখনই বলা যাচ্ছে না।