সৌদি রাষ্ট্রদূতকে ৫০ লাখ ডলারের ফাঁদ: তদন্তে বেরিয়ে আসছে চক্রের ভয়াবহ চিত্র
সম্প্রতি রাজধানীতে এক নাটকীয় গ্রেফতারি অভিযান এবং হাইপ্রোফাইল বিদেশি কূটনীতিককে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অভিযুক্ত মডেল ও উদ্যোক্তা মেঘলা আলম এবং তার সহযোগী মানব পাচার চক্রের হোতা মো. দেওয়ান সমীরের বিরুদ্ধে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে তদন্তে।
মূলত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের টার্গেট করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে অপকৌশলে অর্থ আদায়ের ফাঁদ পেতে আসছিল। তাদের অন্যতম সদস্য ছিলেন ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ ২০২০’ খ্যাত মডেল মেঘলা আলম।
তদন্ত সংস্থার দাবি অনুযায়ী, মেঘলা আলম প্রথমে নিজের সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থান এবং ব্যবসায়িক পরিচয় ব্যবহার করে টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতেন। সখ্যতার একপর্যায়ে ব্যক্তিগত সময়গুলো গোপনে ভিডিও ধারণ করতেন। পরবর্তীতে সেই ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করে শুরু হতো ব্ল্যাকমেইলের খেলা।
তাকে সহায়তা করতেন দেওয়ান সমীরসহ একটি শক্তিশালী প্রতারক চক্র। সমীর ছিলেন কাওয়ালী নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং একটি ম্যানপাওয়ার কোম্পানির মালিক, যার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার ও প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ।
চক্রটির সর্বশেষ টার্গেট ছিলেন সদ্য বিদায়ি সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ বিন ঈসা আল দুহাইলান। তদন্তে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই কূটনীতিকের পেছনে লাগানো হয় মেঘলা আলমকে। ধাপে ধাপে সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো ধারণ করে রাষ্ট্রদূতের কাছে ৫০ লাখ ডলার দাবি করা হয়।
চাপে পড়ে রাষ্ট্রদূত বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায় এবং নির্দেশনা অনুযায়ী গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে মেঘনাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। আটকের কিছুক্ষণ আগে মেঘনা ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করেন, “পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।”
পরদিন ১০ এপ্রিল, পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
চক্রের অন্যতম হোতা দেওয়ান সমীরকেও একই মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং বর্তমানে তিনি ৫ দিনের রিমান্ডে আছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন, দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরী নারীদের ব্যবহার করে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের প্রেমের ফাঁদে ফেলা ও গোপন মুহূর্ত ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করতেন তারা।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, শুধু সৌদি রাষ্ট্রদূতই নয়, আরও কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক এই চক্রের টার্গেট ছিলেন। তাদের অনেকেই এখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন বলে জানিয়েছেন।
মেঘলা আলমের গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডিবি পুলিশের প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিএমপি কমিশনারের এক আদেশে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের অভ্যন্তরেও নানান আলোচনা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, রেজাউল করিম মল্লিকের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে মেঘলার বাবা তার মেয়ের আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। ১৪ এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে জানতে চায়—ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার কেন করা হলো, কারণ না জানিয়ে কেন আটক রাখা হলো, এবং কেন তাকে আইনজীবীর সহায়তা ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি হেফাজতে রাখা হলো।
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভক্ত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, বিদেশি কূটনীতিকদের ব্ল্যাকমেইল করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা মারাত্মক অপরাধ। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রভাবশালী বিদেশিরা এদেশে থেকেও অনেক সময় নৈতিক সীমা লঙ্ঘন করেন, যেটিও তদন্তসাপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন।
তথ্য অনুসারে, মেঘলা আলমের পরিবার মূলত বরিশাল থেকে তিন দশক আগে ঢাকায় আসে। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ২০২০ সালে ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ খেতাব জিতে আলোচনায় আসেন।
পরিবারের দাবি অনুযায়ী, সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার পরিচয় হওয়ার চার মাস পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গোপনে তাদের বাগদান সম্পন্ন হয়। তবে এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি পরিবার।
দেওয়ান সমীরের নেতৃত্বাধীন এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার ও প্রতারণা করে আসছিল। তাদের ম্যানপাওয়ার কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে নারী পাচারের অভিযোগও তদন্তাধীন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেন, “চক্রটি শুধুমাত্র ব্ল্যাকমেইল নয়, বরং নারী নির্যাতন, অনৈতিক কার্যক্রম, বিদেশে পাচারসহ আরও বেশ কিছু অপরাধে জড়িত ছিল।”
ঘটনার পরপরই ঢাকায় অবস্থানরত বেশ কয়েকজন কূটনীতিক নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
মেঘলা আলম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত যতই এগোচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে একটি সুসংগঠিত ব্ল্যাকমেইল চক্রের মুখোশ। যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, প্রযুক্তি, ও সামাজিক চাতুর্য ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও কূটনৈতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।