শিল্পী মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন। হাতে থাকা মুঠোফোনে ছবি দেখে কাঠের বাক্সের ওপর স্থাপিত ককশিটে আঁকছেন ‘স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি’। গভীর মনোযোগে ডুবে থাকায় তিনি সহকর্মীদের ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন না—কারণ, সময় কম। শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেল থেকে আটজন মিস্ত্রি মিলে কাঠের একটি কাঠামো তৈরি করেন। তার ওপর বসানো হয় একটি বড় ককশিট। পাশেই তৈরি হয় একটি মাচা, যেখান থেকে শিল্পী নিজেই আঁকছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী পাশে থাকা সহকর্মীরা তাঁকে সাহায্য করছেন।
এ সময় একজন সাংবাদিক কথা বলতে চাইলে শিল্পী সংক্ষেপে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের সঙ্গে কথা বলুন, এখন আমি ব্যস্ত।” আরেক সাংবাদিক এগোতেই শিল্পীকে সহযোগিতা করা একজন বলে ওঠেন, “সোহাগ ভাই, আপনি কাজ করেন। কিছু বলার দরকার নেই।” তখনই প্রথম জানা যায়, শিল্পীর নাম সোহাগ। পরে এক সহকর্মীর মাধ্যমে জানা যায় তাঁর পুরো নাম—মাহমুদুর রহমান সোহাগ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক। শনিবার বিকেল থেকেই তিনি এই প্রতিকৃতি তৈরিতে কাজ করছেন এবং আগামীকাল ভোরের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন দীপক, মানব ও বুলবুল নামে আরও তিনজন শিল্পী। পুরো দলের নেতৃত্বে আছেন সোহাগ।
এই প্রতিকৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ শোভাযাত্রার অন্যতম মূল আকর্ষণ। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঁশ ও কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছিল এই ‘ফ্যাসিস্টের মুখাকৃতি’। কাজ যখন প্রায় সম্পূর্ণ, তখন গভীর রাতে আগুন দিয়ে তা ধ্বংস করা হয়। হাতে ছিল মাত্র দুই দিন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে—এত অল্প সময়ে নতুন করে এটি তৈরি করা সম্ভব কি না। তবে চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেন, তারা যেকোনো মূল্যে এটি আবার তৈরি করবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন অ্যালামনাই সদস্য শহিদুল ইসলাম শহিদ। তিনি বলেন, “ফ্যাসিস্টের মুখাকৃতি ছিল এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতীক। প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর যখন এটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, আর সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা সেটিকে সম্মানের বিষয় হিসেবে নিয়েছি এবং কাজ শুরু করেছি।”
শহিদুল আরও জানান, প্রতিকৃতি আবার তৈরি হচ্ছে, তবে এর পেছনে ভয় ও চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। তারপরও শিল্পীরা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন যেন সময়মতো কাজ শেষ করা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, শোভাযাত্রার অন্যান্য অনুষঙ্গও প্রস্তুত করা হচ্ছে। রং করা, ছোটখাটো ত্রুটি ঠিক করা, এবং অন্যান্য কাজ চলছে পুরোদমে। চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও কাজের তত্ত্বাবধানে উপস্থিত।
শনিবার রাতে প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, “এই প্রতিকৃতি কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, এটি একটি প্রতীক—যা অন্যায়, দমন-পীড়ন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে প্রকাশ করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। বাধা এসেছে, ষড়যন্ত্রও হয়েছে, কিন্তু মানবিকতা, পরিশ্রম ও বিশ্বাসকে অস্ত্র করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ প্রয়াসে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।”