জাতীয় নির্বাচন সামনে: সংস্কার কার্যক্রমে গতি আনার তাগিদ
ঢাকা, শনিবার: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এবং সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রমে গতি আনার ওপর জোর দিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার বিকেলে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার। বৈঠকে দেশব্যাপী চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
বৈঠকে কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ এবং সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের বর্তমান অগ্রগতি তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত আটটি দলের সঙ্গে আলোচনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই আলোচনার মাধ্যমে কমিশন গণতন্ত্র ও সুশাসনের ধারাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি বাস্তবভিত্তিক রূপরেখা প্রণয়নে সচেষ্ট।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জনগণের মতামত যাচাই এবং জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাগুলোও কমিশনের বিবেচনায় আসবে।
বৈঠকে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আগামী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল–বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সময়সূচি নির্ধারিত হয়েছে বলে জানানো হয়। কমিশন আশা করছে, বিএনপির সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রান্ত হবে।
কমিশনের লক্ষ্য হলো, নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নির্বাচনী আচরণবিধি ও রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সর্বদলীয় ঐকমত্য গঠন করা।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে বলেন, “যেহেতু ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই আমাদের সংস্কার কার্যক্রমে এখনই গতি আনতে হবে। কোনো বিলম্ব আমাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপকে কেন্দ্র করে আমরা যদি সমন্বিত, টেকসই ও অংশগ্রহণমূলক একটি সংস্কার কাঠামো গঠন করতে পারি, তবে তা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে।”
সংস্কার কমিশন জানিয়েছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিভাগীয় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদরগুলোতে ‘গণসংলাপ’ ও ‘জনমত যাচাই’ শীর্ষক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে। এতে অংশ নেবেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, তরুণ প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। এই সংলাপগুলো থেকে প্রাপ্ত মতামত ও তথ্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচারাভিযানের মাধ্যমে সংস্কার বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছে, একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সমন্বিত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে নির্বাচনী খরচ সীমিতকরণ, প্রার্থীদের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, ভোটার তালিকার যথার্থতা এবং নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
একাধিক দলের পক্ষ থেকে কমিশনকে সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মানোন্নয়ন এবং নির্বাচনী অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা যায়।
সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো—নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। বিগত বছরগুলোর বিতর্কিত নির্বাচন অভিজ্ঞতা এবং দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে।
তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম, সংলাপভিত্তিক সংস্কার উদ্যোগ, এবং প্রফেসর ইউনূসের নিরপেক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই সংস্কার কার্যক্রমের গুরুত্ব বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ, জনগণের মতামত, এবং কমিশনের নিরপেক্ষতা—এই তিনের সমন্বয়েই গঠিত হতে পারে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ।
প্রধান উপদেষ্টা ও চেয়ারম্যান প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে যদি সংস্কার প্রক্রিয়া যথাসময়ে সম্পন্ন হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করে, তবে ২০২৫ সালের নির্বাচন হতে পারে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দিগন্তের সূচনা।