ফিলিস্তিনের জন্য এক কাতারে লাখো মানুষ: সোহরাওয়ার্দীতে ‘মার্চ ফর গাজা’
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হলো এক ব্যতিক্রমধর্মী গণজমায়েত—‘মার্চ ফর গাজা’। ১২ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার দুপুরে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে লাখো মানুষ অংশ নিয়ে গাজা-বাসীর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম, পেশা ও বয়সের পার্থক্য ভুলে একত্রিত হন সবাই। এই ব্যতিক্রমী সমাবেশ দেশের ইতিহাসে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতির সবচেয়ে বড় প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দুপুর তিনটার পরপরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এই কর্মসূচি শুরু হয় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। এরপর একে একে মঞ্চে উঠে বক্তব্য দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতারা। আয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘ঘোষণাপত্র পাঠ’। এটি পাঠ করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ঘোষণাপত্রে বিশ্ব মুসলিমকে এক হওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে গাজায় চলমান বর্বরতা বন্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়।
লাখো মানুষের ঢল
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হতে থাকেন সকাল থেকেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাগম পরিণত হয় জনস্রোতে। শুধু পুরুষ নয়, নারী, শিশু, তরুণ-তরুণী, বয়স্ক—সবার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা, পোস্টার, ব্যানার বহন করছিলেন; যেগুলোর বার্তা ছিল স্পষ্ট—”গাজা গণহত্যা বন্ধ করো”, “ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায়বিচার চাই”, “নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধী” ইত্যাদি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গড়ে ওঠা এই ব্যতিক্রমী গণমঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী আন্দোলন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি সহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। রাজনীতির বিভাজন ভুলে তারা এক কণ্ঠে ফিলিস্তিনের মুক্তির ডাক দেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা।
মঞ্চ থেকে দেওয়া বক্তৃতায় বারবার উঠে আসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার কথা। বক্তারা বলেন, ইসরাইলের এই নিষ্ঠুর আগ্রাসন যদি আজ রোখা না যায়, তাহলে মানবতা ধ্বংসের মুখে পড়বে। বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও এর পেছনে জড়িত কুশীলবদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়।
এই কর্মসূচিতে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক। মোনাজাতে অংশগ্রহণকারীরা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ফিলিস্তিনের শহীদদের জন্য দোয়া করেন এবং গাজার শিশুদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কামনা করেন।
মাওলানা মালেক বলেন,
“গাজায় যা হচ্ছে, তা শুধু ফিলিস্তিনের সমস্যা নয়, এটা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইজ্জত, মানবতার ইজ্জতের ওপর আঘাত। আজকের এই জমায়েত প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশ এখনও মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে।”
ঘোষণাপত্রে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, “পশ্চিমা দেশগুলো যদি তাদের স্বার্থে ইসরাইলকে সমর্থন দিতে পারে, তবে মুসলিম বিশ্ব কেন তাদের ভাই-ভগ্নিদের জন্য এক হতে পারবে না?”
বক্তারা আরও বলেন, “ফিলিস্তিন শুধু আরবদের নয়, আমাদের সবার। আমাদের দায়িত্ব এখন শুধুই সহানুভূতির প্রকাশ নয়, পদক্ষেপ গ্রহণ।”
এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ ছিল সাধারণ মানুষ। তাঁরা বলছেন, ফিলিস্তিনের শিশুদের কান্না আমাদের বিবেক নাড়া দিয়েছে। মিরপুর থেকে আসা একজন তরুণ বলেন,
“আজ আমার ভাই গাজায়। আমি তার জন্য এই মঞ্চে। আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, আমি শুধু মানবতার পক্ষে।”
এই জাতীয় ঐক্য ও সংহতির দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিরল। যেখানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন, সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ, সাধারণ জনগণ একসাথে একই লক্ষ্য নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন—এমন দৃশ্য ইতিহাসে বিরল।
অনেক বেসরকারি টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এই কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হ্যাশট্যাগ #MarchForGaza ট্রেন্ড করতে থাকে সারা দিন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই আয়োজনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে।
ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ও বার্তা
‘মার্চ ফর গাজা’ শুধু একটি কর্মসূচি নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মানবিক চেতনার প্রতীক। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে—বাংলাদেশ নিপীড়িতের পাশে, মানবতার পক্ষে, ন্যায়ের সাথে।
- ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বৃহৎ গণসমাবেশ
- দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের অনন্য নজির
- ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের আহ্বান
- নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকার আহ্বান
এই সমাবেশের পর ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে বাংলাদেশে আরও কর্মসূচি হতে পারে বলে আয়োজকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা বলছেন, “মানবতার জন্য লড়াই চলবে, যতদিন না গাজায় শান্তি আসে।”