স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বাস্তবতার হিসাব-নিকাশ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, কোনো আলোচনার টেবিলে নয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল নিছক একটি সামরিক লড়াই নয়, বরং এটি ছিল আপামর জনসাধারণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এক জনযুদ্ধ। আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সেই সংগ্রামের চেতনা ও প্রত্যাশা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শোষণ, বৈষম্য ও রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, যা ক্রমেই স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের স্পষ্ট বার্তা। এরপর ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়—সবই ছিল বাঙালির স্বাধীনতার পথে অগ্রযাত্রা।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস জুড়ে গোটা বাংলাদেশ ছিল আন্দোলনের আগুনে উত্তাল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করলেও, মূলত তারা রচনা করছিল ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে চালানো হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’, যেখানে হাজারো নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পর থেকেই শুরু হয় সুসংগঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পায় আনুষ্ঠানিক রূপ।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাঙালির অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগের কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা, আর লাল-সবুজ পতাকা উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ফসল এই স্বাধীনতা। বীর প্রতীক লে. কর্নেল (অব.) মোদাসসের হোসেন খান বলেন, “যুদ্ধের সময় পুরো জাতি এক হয়েছিল। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল—কেউ সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কেউ নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করেছে।”
পাঁচ দশকের বেশি সময় পার করলেও স্বাধীনতার মূল চেতনা—গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোদাসসের হোসেন খান বলেন, “দেশের শিক্ষার হার বেড়েছে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, প্রযুক্তিতে উন্নয়ন হয়েছে। তবে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার খুবই সামান্য অংশ পূরণ হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—এগুলো এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, “যারা স্বাধীনতার আগে শক্তিশালী ছিল, তারা স্বাধীনতার পর আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি।”
৫৪ বছরের পথচলায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে, প্রযুক্তিতে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য আরও পথ পাড়ি দিতে হবে।
৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো লাল-সবুজ পতাকা শুধু স্বাধীনতার প্রতীক নয়, এটি আমাদের দায়িত্ব ও অঙ্গীকারের স্মারক। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে স্বপ্নের ঠিকানায়—এটাই সবার প্রত্যাশা।