গণমাধ্যম সংস্কার: অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ ও সুপারিশ বাস্তবায়ন
গণমাধ্যমের উন্নতি এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন যে, কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অনতিবিলম্বে কার্যকর করা হবে। শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই প্রতিবেদন হস্তান্তরকালে তিনি এ কথা বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যে সব সুপারিশ দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব, আমরা সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাই। তাই আমি চাইবো, কমিশন আশু করণীয় সুপারিশগুলো আলাদাভাবে পেশ করুক, যাতে আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারি।”
- গণমাধ্যমের মালিকানায় একক আধিপত্য কমানোর উদ্যোগ।
- পাবলিক কোম্পানি হিসেবে বৃহৎ গণমাধ্যম পরিচালনা।
- বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ।
- সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তা।
- সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বেশ কিছু মৌলিক এবং সময়োপযোগী সুপারিশ করেছে, যা বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
১. একক মালিকানার সমস্যার সমাধান
গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে একক মালিকানা একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ কারণে কমিশন সুপারিশ করেছে যে, বড় এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো পাবলিক কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হবে। এতে গণমাধ্যমে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে।
২. মালিকানা সীমিতকরণ
একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র একটি গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবে, যাতে সংবাদ মাধ্যমের বৈচিত্র্য ও প্রতিযোগিতা বজায় থাকে। এতে করে একক মালিকানার কারণে সৃষ্ট প্রভাবশালী চক্র ভেঙে দেওয়া সম্ভব হবে।
৩. রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা
বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এবং বাংলাদেশ বেতার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় এগুলোর স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। কমিশন সুপারিশ করেছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে একটি জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা গঠন করা হবে এবং এটি একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের অধীনে পরিচালিত হবে।
৪. বাসস-এর পুনর্গঠন
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বাসস-কে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং এটিকে জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার অংশ করা হবে।
৫. সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইন
সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে কমিশন মনে করে। এজন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশও জমা দেওয়া হয়েছে, যা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।
৬. প্রেস কাউন্সিল বিলুপ্তকরণ
বর্তমানে প্রেস কাউন্সিলের কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কমিশন সুপারিশ করেছে যে, এটি বিলুপ্ত করে একটি স্বাধীন জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হবে, যেখানে রেডিও ও টেলিভিশনও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
৭. সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা
সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিশন সুপারিশ করেছে যে, বিসিএস ক্যাডারদের নবম গ্রেডের সমপরিমাণ বেতন সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া, ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য ‘ঢাকা ভাতা’ চালু করারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
৮. দুর্নীতি প্রতিরোধ
গণমাধ্যমে দুর্নীতি রোধে বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে। বিশেষ করে সরকারি বিজ্ঞাপন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, মিডিয়া লিস্ট তৈরি ও সরকারি বিজ্ঞাপন বিতরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়, যা রোধ করা জরুরি।
৯. টিআরপি জালিয়াতি বন্ধ
কমিশন টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) ব্যবস্থায় জালিয়াতির কথা উল্লেখ করেছে এবং এই সমস্যার সমাধানের জন্য একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নির্দিষ্ট স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে বাধ্য, যার ফলে বিদেশ থেকে এসব চ্যানেল দেখা সম্ভব হয় না। কমিশন এই সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সরকার দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সাংবাদিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকে মনে করছেন, এই সংস্কার বাস্তবায়ন হলে গণমাধ্যমে স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। তবে কিছু মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আরও স্বাধীন ও কার্যকর হয়ে উঠবে। তবে এটি নির্ভর করবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ওপর।
গণমাধ্যম সংস্কারের উদ্যোগ একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। একক মালিকানার প্রভাব কমানো, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বাসস ও রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি বিজ্ঞাপন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা হলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো কার্যকর করা হয়, তবে তা দেশের গণমাধ্যমের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।