ঝিনাইদহে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, বিএনপি কর্মী নিহত
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হাকিমপুর গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোশাররফ হোসেন (৩৩) নামে এক বিএনপি কর্মী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও আটজন। মঙ্গলবার সকালে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চানপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন এবং একই এলাকার বিএনপি কর্মী ও গ্রামের মাতবর দবির উদ্দিনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল। মঙ্গলবার সকালে এ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।
নিহত মোশাররফ হোসেন দবির উদ্দিনের ভাই। ঘটনার দিন তিনি সকালে হাকিমপুর গ্রামের মাঠে কলা কাটতে গেলে প্রতিপক্ষের লোকজন তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। খবর পেয়ে উভয় পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে মোশাররফসহ ৯ জন গুরুতর আহত হন। আহতদের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোশাররফকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের ভাই দবির উদ্দিন বলেন, “সকালে আমার ভাই মাঠে কাজ করছিল। এ সময় মহিউদ্দিনের লোকজন তার ওপর হামলা চালায়। আমার ভাই বাঁচার জন্য বাড়ির দিকে দৌড় দিলে তারা পিছু ধেয়ে বাড়ির সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।” এ ঘটনার পর স্থানীয়রা প্রতিপক্ষের কয়েকজনকে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
এ বিষয়ে হরিণাকুণ্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ রউফ খান বলেন, “আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।”
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফারহানা শারমিন জানান, “আহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহতদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।”
স্থানীয়দের মতে, সংঘর্ষের পেছনে মূলত রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারই প্রধান কারণ। তবে এই বিরোধের পেছনে ব্যক্তিগত আক্রোশও থাকতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। চানপুর ইউনিয়ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই আধিপত্য নিয়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছিল।
এই অঞ্চলে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের সংঘর্ষে প্রথমবারের মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাকিমপুর গ্রামে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। এই দ্বন্দ্বের ফলে গ্রামবাসী দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় পরবর্তী সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনার জেরে উত্তেজনা আবারও বাড়তে পারে।
হাকিমপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে। তারা দাবি করেন, প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ না হলে এ ধরনের সংঘর্ষ আরও ঘটতে পারে।
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিরোধ দেখে আসছি। কিন্তু এবার যা হলো, তা খুবই দুঃখজনক। আমরা চাই প্রশাসন যেন দ্রুত এর সুষ্ঠু সমাধান করে।”
এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে হরিণাকুণ্ডু থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে এবং ঘটনা তদন্তের জন্য একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে।
ওসি এম এ রউফ খান বলেন, “আমরা তদন্ত করছি এবং যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।”
এই ধরনের সংঘর্ষ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও সমাজের সুশীল সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্থানীয়ভাবে বিরোধ মেটাতে সালিশি বৈঠক, শান্তি কমিটি গঠন এবং প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্রামের সাধারণ মানুষ চায়, এই ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। তারা চান প্রশাসন আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং রাজনৈতিক নেতারা সহিংসতা থেকে বিরত থাকবেন।
গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা চাই শান্তি। রাজনীতি আমাদের জীবনে উন্নয়ন আনবে, কিন্তু এই ধরনের সহিংসতা আমাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আমাদের আবেদন, যেন এই সমস্যা দ্রুত সমাধান হয়।”
হরিণাকুণ্ডুর হাকিমপুর গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোশাররফ হোসেনের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। এই ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটে।