তদন্ত চলছে, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পুলিশের
নোয়াখালীর কবিরহাটে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে জহির উদ্দিন বেচু (৪০) নামের এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার ছবির পাইক গ্রামে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। নিহত জহির উদ্দিন বেচু উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর লামছি গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম প্রয়াত মোঃ মোস্তফা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত ব্যক্তি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী ছিলেন। বেচু চার সন্তানের জনক। তার বিরুদ্ধে এর আগে কখনো বড় ধরনের চুরির অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার রাতে জহির উদ্দিন বেচু প্রথমে ধুমচর ছমিরপাইক মসজিদের তালা ভাঙার চেষ্টা করেন। মসজিদের ইমাম বিষয়টি টের পেলে তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। কিছুক্ষণ পর মসজিদের পাশের একটি চায়ের দোকানে প্রবেশের চেষ্টা করলে ইমাম মুঠোফোনে আশপাশের লোকজনকে খবর দেন। মুহূর্তের মধ্যেই স্থানীয়রা সেখানে জড়ো হন।
দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত লোকজন তাকে ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে বেচু মাটিতে পড়ে গেলে গণপিটুনি শুরু হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি দীর্ঘ সময় ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিলেন।
পরে সকাল ৮টার দিকে স্থানীয়রা তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই জহির উদ্দিন বেচু মারা যান।
“জহির উদ্দিন বেচু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতা পেয়ে আসছিলেন। চার সন্তানের জনক বেচু মাঝে মাঝে ছোটখাটো ঘটনা ঘটালেও বড় কোনো অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। তার বোন ও খালার বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় তিনি প্রায়ই ওই এলাকায় যাওয়া–আসা করতেন।”
ঘটনার বিষয়ে কবিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ শাহিন মিয়া বলেন,
“গণপিটুনিতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়রা এই ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে মনে করছেন, জহির উদ্দিন বেচু মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন বলে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে, পুলিশ ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, গণপিটুনিতে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য সিসিটিভি ফুটেজ এবং স্থানীয়দের বক্তব্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এই ঘটনা বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধী সন্দেহ হলে যথাযথ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ জানানো উচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
জহির উদ্দিন বেচুর মৃত্যু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতি সমাজের উদাসীনতার আরেকটি করুণ উদাহরণ। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য নয় এবং অনেক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশেষায়িত সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই ঘটনা ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে আমাদের সচেতন হতে শেখায়। জনগণকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আইন নিজের হাতে না তুলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দেওয়া এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করাই হবে সঠিক পদক্ষেপ।