মনিপুর সহিংসতায় বিজেপির ভূমিকা নিয়ে নতুন ইঙ্গিত
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্য মনিপুরে দীর্ঘদিন ধরে চলমান জাতিগত সংঘাতের পেছনে বিজেপি সরকারের গভীর সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত মিলেছে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি কল রেকর্ডে মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং নিজেই সহিংসতায় সরাসরি ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কল রেকর্ডে তাকে কুকি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে সংঘাত উসকে দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশ দিতে শোনা গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংয়ের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি রাজ্যের কুকি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিগত দেড় বছর ধরে মনিপুরে চলমান সহিংসতায় ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে নতুন নতুন সংঘাত। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, নারী নির্যাতন, এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ভয়াবহ ঘটনা এখানকার মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।
রাজ্যের এই সহিংসতা নিয়ে বারবার মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং। কিন্তু সাম্প্রতিক কল রেকর্ড ফাঁসের মাধ্যমে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। এতে বোঝা যাচ্ছে, বাইরের কোনো শক্তি নয়, বরং বিজেপি সরকারই মনিপুরের অস্থিরতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মনিপুরের মেইতেই এবং কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। ২০২৩ সালে এই বিরোধ ভয়াবহ রূপ নেয় এবং তা আজও অব্যাহত। কল রেকর্ডে উল্লেখ রয়েছে যে, এই জাতিগত বিভাজনকে বিজেপি সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মনিপুরের সংঘাত বিজেপির “বিভাজন এবং শাসন” নীতির অংশ। মেইতেই জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে রাখতে কুকি জনগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করা হয়েছে। এর ফলে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আরও গভীর হয়েছে।
মনিপুর সংকট শুরুর পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একবারও রাজ্য সফর করেননি। সংঘাত মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং যেখানে সংঘাতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগের মুখোমুখি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদির নীরবতা আরও সন্দেহজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
মনিপুরের চলমান সহিংসতা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে। কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর মোদি সরকারের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতো সংস্থা মনিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক স্বাধীন পর্যবেক্ষক পাঠানোর দাবিও উঠেছে।
সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। অনেকেই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। নারী নির্যাতন এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
“আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা আর নিরাপদ নই। এই সংঘাত কখন শেষ হবে, আমরা জানি না।”
কল রেকর্ড ফাঁসের পর এন বিরেন সিংয়ের পদত্যাগের দাবিতে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ইস্যু বিজেপি সরকারের জন্য বড় রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
“জাতিগত সংঘাতকে উসকে দেওয়ার মতো অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তবে এটি ভারতীয় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে থাকবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মনিপুরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা। সংঘাতে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মনিপুরের চলমান সহিংসতা এবং সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কল রেকর্ড ভারতের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সংকট দ্রুত সমাধান না হলে মনিপুরের জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে মোদি সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।