নতুন পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন: শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লবের ছোঁয়া
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০১২ সালের কারিকুলাম পুনরায় চালু করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের চালু করা সৃজনশীল শিক্ষাক্রম বাতিল করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই গত ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন পাঠ্যবইয়ে যে পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে, তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নতুন পাঠ্যবইয়ে দেশের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গল্প, ছবি, কার্টুন ও গ্রাফিতি সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের সময় সরকারের পতন এবং সরকারপ্রধানের দেশত্যাগের ঘটনাও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য উপস্থাপিত এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক অতিকথন বাদ দিয়ে বাস্তবতাভিত্তিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
নতুন পাঠ্যবইয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অতিরিক্ত বন্দনা কমিয়ে এনেছেন এবং তার পাশাপাশি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণায় মেজর জিয়াউর রহমানের অবদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠ বইয়ে ‘কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপানো হয়েছে। এই লেখায় ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কার্টুনের ভূমিকা দেখানো হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে সংযোজন করা হয়েছে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ বিভিন্ন শহীদের পাশাপাশি ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া আবু সাঈদ এবং মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর নাম যুক্ত করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্মমভাবে প্রাণ হারান। রংপুরের ছাত্রনেতা আবু সাঈদের জীবন উৎসর্গ এবং রাজধানীর উত্তরায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর আত্মত্যাগের ঘটনা শিক্ষার্থীদের স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে তাদের অবদান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নবম ও দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পুনরুল্লেখ করা হয়েছে।
নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। গণভবন ঘেরাও এবং দেশের মানুষ কীভাবে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন যে নতুন পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের অভ্যুত্থান ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একটি মাইলফলক। আমরা এই অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করেছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।”
এছাড়া শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নতুন পাঠ্যবইয়ে কবিতা, ব্যঙ্গচিত্র এবং ইতিহাসভিত্তিক বিভিন্ন অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘সিঁথি’ নামে একটি কবিতা সংযোজন করা হয়েছে, যেখানে রংপুরের ঘটনা এবং ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর সঠিক উপস্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য এই পরিবর্তনগুলো একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এই পাঠ্যবই শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধি করবে না, বরং তাদের ভবিষ্যতে একটি দায়িত্বশীল এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।