বিশ্ব ইজতেমার মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং মুসল্লিদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী স্টেশন রোড ও মিলগেট এলাকায় শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পেট্রোল কমান্ডার জানান, “জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী সবসময় মাঠে থাকে। তবে বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে গতকালের ঘটনার পর আমরা আরও সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।”
এছাড়া ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকায় পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন এবং সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থী মুসল্লিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) জুবায়েরপন্থীদের হামলায় সাদপন্থীদের পাঁচজন মুরুব্বি আহত হন। এ ঘটনায় টঙ্গী পশ্চিম থানায় জুবায়েরপন্থীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ৩৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং আরও ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
সাদপন্থীদের মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম বলেন, “গতকালের হামলায় আমাদের পাঁচজন সাথী আহত হয়েছেন এবং একটি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। আমরা শিহাব উদ্দিনকে বাদী করে একটি মামলা করেছি। তবে তদন্তের স্বার্থে আসামিদের নাম এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে, জুবায়েরপন্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাদপন্থীদের মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, “সাদপন্থীদের মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে আজ বাদ জুমা আমরা বিক্ষোভ মিছিল এবং গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করব।”
সরেজমিনে জানা গেছে, জুবায়েরপন্থী মুসল্লিদের কয়েক হাজার সদস্য ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, তুরাগ নদীর পশ্চিম তীরে সাদপন্থীদের মসজিদের সামনে আরও কয়েক হাজার মুসল্লি অবস্থান করছে। উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান বলেন, “সাদপন্থীদের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, দুই পক্ষের উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও র্যাবের সদস্যরা স্থানীয় এলাকায় টহল জোরদার করেছে।
বিশ্ব ইজতেমার এই উত্তেজনা নিয়ে সাধারণ মুসল্লি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী হাসান উদ্দিন বলেন, “ইজতেমার মতো পবিত্র আয়োজনকে ঘিরে এই ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। আমরা চাই প্রশাসন দ্রুত সমস্যার সমাধান করুক।”
অন্যদিকে, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজনেরা এই পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “ইজতেমা একটি শান্তিপূর্ণ ও ধর্মীয় পরিবেশের প্রতীক। এখানে এ ধরনের সংঘর্ষ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ইসলামি ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর।”
বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে সংঘর্ষ ও উত্তেজনা নিরসনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উভয় পক্ষের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, তারা মাঠের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে, স্থানীয় বাসিন্দারা ও সাধারণ মুসল্লিরা আশা করছেন, উভয় পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করবেন।
বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় আয়োজন। এই আয়োজন ঘিরে সংঘর্ষ ও উত্তেজনা শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও দৃষ্টিকটু। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং উভয় পক্ষের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামি ঐক্য ও সবার জন্য শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। তাই, এই উদ্দেশ্য সফল করতে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।