সরকার ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে খোলা বাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়ার কাছ থেকে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। প্রতি ইউনিট এলএনজি ১৫.০২ ডলারে ক্রয় করতে গিয়ে সরকারের মোট ব্যয় হবে ৭০৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এলএনজির এই কার্গো ২০২৪ সালের ৪ থেকে ৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে পৌঁছাবে।
বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, “জ্বালানি খাতকে স্থিতিশীল রাখা এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।”
এলএনজির পাশাপাশি, সরকার ২০২৫ সালের জন্য আবুধাবির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (এডনক) থেকে ৬ লাখ টন মারবান গ্রেড অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সৌদি আরামকো থেকে ৭ লাখ টন এরাবিয়ান লাইট ক্রুড কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এ দুটি চুক্তির সম্মিলিত খরচ হবে যথাক্রমে ৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা এবং ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তিশালী সরবরাহ চেইন বজায় রাখা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতার মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
দেশের শিল্প ও পরিবহন খাতের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে, জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত ইউনিপ্যাক সিঙ্গাপুর, ভিটল এশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওকিউ ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই চুক্তিতে সরকারের ব্যয় হবে ১০ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির এ উদ্যোগ দেশের শিল্পখাতকে সচল রাখতে সহায়তা করবে এবং বিদ্যমান জ্বালানি সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জ্বালানির পাশাপাশি খাদ্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার স্থানীয়ভাবে ৩৮ লাখ ১০ হাজার লিটার খোলা সয়াবিন তেল এবং এক কোটি ১০ লাখ লিটার পাম তেল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। সয়াবিন তেলের প্রতি কেজির দাম ১৪০ টাকা এবং পাম তেলের প্রতি লিটার ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দুটি চুক্তির জন্য ব্যয় হবে যথাক্রমে ৫৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ১৪৩ কোটি টাকা।
এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি এই তেল সরবরাহ করবে। সরকারের এই উদ্যোগ ভোক্তাদের জন্য খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বৈঠকে কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের সার আমদানি অনুমোদিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো না হলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ উদ্যোগ দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারি উদ্যোগে নেওয়া এ ধরনের পদক্ষেপ কৃষকদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করতে পারে এবং দেশীয় কৃষিক্ষেত্রকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এ ধরনের উদ্যোগ সঠিক দিকনির্দেশনার উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএনজি, জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্য আমদানির এ পদক্ষেপ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে সরকারের এই কৌশল শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের এ উদ্যোগগুলো দেশের শিল্প, কৃষি, এবং জ্বালানি খাতে স্থিতিশীলতা আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তনশীলতার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কৌশল বাস্তবায়ন উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।