বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র জমা না দেওয়ার কারণে সারাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে ৭৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এই অস্ত্রগুলোর মালিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৫ আগস্ট একটি বিশেষ ঘোষণা জারি করে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে (২০০৯-২০২৪) দেওয়া সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। লাইসেন্সধারীদের ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ অস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি। এই পরিস্থিতিতে ৭৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, লাইসেন্স বাতিল হওয়া অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ। এসব অস্ত্র উদ্ধারের জন্য দেশের সব জেলা পুলিশের সুপারদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
লাইসেন্স বাতিল হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, এবং প্রভাবশালী নেতারা রয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদে অনেক অস্ত্র বৈধতার আড়ালে অবৈধভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক অস্ত্র রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শন করা হয়েছে বা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের উদাহরণ এই প্রভাবশালী অস্ত্রধারীদের কার্যকলাপের চিত্র তুলে ধরে। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের নামে আটটি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে, যেগুলো জমা দেওয়া হয়নি। প্রশাসন জানিয়েছে, এই পরিবারের কেউ ভারতে পালিয়ে গেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই জেলার ২৬টি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা দেশে রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে প্রশাসনের একাংশের মতে, পুলিশের গাফিলতির কারণে অস্ত্র উদ্ধারের প্রক্রিয়া ধীরগতি হয়েছে।
বাতিল হওয়া লাইসেন্সগুলোর বেশির ভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনা, এবং সিলেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোর। তবে, এখনো অস্ত্র উদ্ধার এবং মালিকদের অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি।
যাঁরা বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অস্ত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে অস্ত্র ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর একজন প্রতিনিধি এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
কমিটির দায়িত্ব হলো জমা দেওয়া অস্ত্রের আবেদন পর্যালোচনা করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া। যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে বা দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁদের অস্ত্র ফেরত দেওয়া হবে না।
‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী, লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করার কথা। তবে, সাবেক সরকারের সময়ে এই নীতিমালার বারবার লঙ্ঘন হয়েছে। বৈধ অস্ত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা এবং অন্যকে ভয় দেখানোর ঘটনায় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার এবং লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অবৈধ অস্ত্র এবং লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, অস্ত্র উদ্ধার এবং ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম আরও জোরালোভাবে পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে গতি এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করার দাবি উঠেছে।