বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার পর। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টায় ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়।
হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, এই হামলা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক আন্তর্জাতিক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন। অন্যদিকে, ভারতও ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে একটি সহিংস হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এ ঘটনা ঘটায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি, যা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সহযোগী সংগঠন, এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়।
হামলাকারীরা মিশনের প্রধান ফটক ভেঙে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এবং সম্পত্তি ভাঙচুর করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, “এটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা।”
এর আগে একই দিন মুম্বাইয়ের বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কাছাকাছি ভিএইচপির আয়োজনে একটি বিক্ষোভ হয়, যেখানে কয়েকশ’ লোক অংশ নেয়। এই ঘটনার সঙ্গে আগরতলার হামলার একটি সংযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হামলার পর বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কড়া নিন্দা জানায় এবং ভারতের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতিমালা ও প্রোটোকলের লঙ্ঘন। আমরা এ ধরনের আক্রমণ মেনে নেব না।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে এই হামলা সম্ভব হয়েছে। আমরা মনে করি, এই আক্রমণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সনদের মৌলিক নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে।”
হামলার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, “কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তিকে কোনো অবস্থায়ই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। আমরা দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া, দায়িত্বে অবহেলার জন্য চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত এবং একজন উপ-পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, এই হামলা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশন (১৯৬১) লঙ্ঘন করেছে। এই সনদে বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো অন্য দেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
হামলাকারীরা কূটনৈতিক মিশনের প্রধান ফটক ভেঙে অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় এবং জাতীয় পতাকা অবমাননা করায় আন্তর্জাতিক নীতিমালা স্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
ত্রিপুরার পুলিশ সাতজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন ঝুতন দাস, উজ্জ্বল দাস, দীপ্তনীল ভৌমিক, সুরজা দাস, ঝুলন মালাকার, প্রদীপ সাহা এবং অলক মজুম।
এছাড়া, পুলিশের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা গুলো হলো:
এক উপ-পুলিশ সুপারকে (ডিওয়াইএসপি) প্রত্যাহার।
তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত।
হামলায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে, এই হামলার মতো ঘটনা দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “একটি ঘটনার কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আটকে থাকবে না। আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং আমরা তা আরও জোরদার করতে চাই।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কূটনৈতিক মিশনের ওপর হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতি অসম্মান।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই ঘটনার সমাধানে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা।
ভারতকে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হামলার পেছনের কারণ এবং সংগঠকদের খুঁজে বের করতে হবে।
দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা আরও বাড়াতে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক জরুরি।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে উভয় পক্ষ শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব দিয়েছে। দুই দেশের সরকার এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হতে পারে।