‘জয় বাংলা’—স্বাধীনতার সুর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে এবার শুরু হয়েছে আইনি লড়াই। হাইকোর্টের রায়ে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করা হলেও তা স্থগিত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এ সংক্রান্ত আবেদনটি শুনানির জন্য আগামী রোববার (৮ ডিসেম্বর) আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর ফলে হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা আপাতত প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ, ‘জয় বাংলা’কে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক রায় দেন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে বলা হয়, ‘জয় বাংলা’ শুধু একটি স্লোগান নয়; এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত প্রতীক এবং জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হাইকোর্টের এই রায় আসে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে। রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ব্যবহার করতেন, যা দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হাইকোর্টের রায় ঘোষণার প্রায় দুই বছর পর, ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তে রায়ের সাংবিধানিক ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়।
তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করায় বিষয়টি নতুন মোড় নিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের এই স্থগিত আবেদনের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেছেন, ‘‘রায়টি স্থগিত করা প্রয়োজন, কারণ এটি কিছু সাংবিধানিক ও আইনগত প্রশ্ন উত্থাপন করে।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মূলত জাতীয় স্লোগানের সংজ্ঞা, প্রাসঙ্গিকতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে আইনি বিশ্লেষণের দাবি করছে।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ছিল প্রেরণার প্রধান উৎস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে বারবার উচ্চারিত এই স্লোগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন জাতীয় দিবস এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হয়েছে। যদিও এক সময় এটি ব্যবহার কমে আসে, গত এক দশকে স্লোগানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে।
‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পক্ষে সমর্থকদের যুক্তি হলো, এটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই নয়, বরং তা জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির প্রতীক। অন্যদিকে, কিছু আইনবিদ এবং বিশ্লেষক এ নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। তাদের মতে, একটি স্লোগানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন দেওয়া সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ওপর নির্ভর করছে ‘জয় বাংলা’র ভবিষ্যৎ। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকলে ‘জয় বাংলা’ শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং তা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, আপিল বিভাগ রায় স্থগিত করলে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী আইনি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
‘জয় বাংলা’ শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জাতীয় পরিচয়ের গভীরতম প্রতীক। তবে আইনি জটিলতা বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আপিল বিভাগে শুনানির মাধ্যমে জাতি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে—‘জয় বাংলা’ কি শুধুই ইতিহাসের স্মারক, নাকি তা জাতীয় পরিচয়ের অনিবার্য অংশ?