পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কুররম জেলার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চরমে পৌঁছেছে। সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান বিরোধ গত কয়েকদিনে ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ২০০ যানবাহনের বহরে হামলার পর শনিবার নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হলে কমপক্ষে ১৮ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। এর আগে বৃহস্পতিবার কুররমের বাগান এলাকায় আরেক সংঘর্ষে ৪৩ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়েছিলেন।
কুররম জেলা আফগান সীমান্তের কাছে অবস্থিত একটি কৌশলগত এলাকা। অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এবং ভূমি বিরোধে জর্জরিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ভূমি অধিকার নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ফের বেড়ে গেছে। এই বিরোধের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যোগ হওয়ায় সংঘর্ষের মাত্রা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের মতে, এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে জমি ও সম্পদ নিয়ে সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। সাম্প্রতিক হামলাগুলোর সঙ্গে ঐতিহাসিক বিদ্বেষ এবং আধিপত্য বিস্তার চেষ্টার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা ছিল সংঘর্ষের সূচনা। একটি শিয়া বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এতে ৪৩ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বহরের চারপাশ থেকে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করা হয়, যা প্রায় ৩০ মিনিট ধরে চলেছিল।
শনিবার এই সংঘর্ষ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন গ্রুপ একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা চালায়। নিহতদের মধ্যে সাতজন নারী ও তিনজন শিশু রয়েছে। আহতদের মধ্যে নয়জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের পেশোয়ারের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
কুররমের ডেপুটি কমিশনার জাভেদুল্লাহ মেহসুদ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে। শনিবার কুররমের সম্মেলন কক্ষে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেপি পুলিশের মহাপরিদর্শক আখতার হায়াত খান, মুখ্য সচিব নাদিম আসলাম চৌধুরী এবং সরকারি মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলি সাইফ উপস্থিত ছিলেন।
তবে সংঘর্ষের মাত্রা এবং এলাকায় মোবাইল সিগন্যাল বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসনকে কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কুররমের সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ১৪ বছর বয়সী এক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, সংঘর্ষে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কায়সার আব্বাস জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চিকিৎসার প্রয়োজনে তাদের পেশোয়ারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ সংঘর্ষ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সাবেক সংসদ সদস্য সাজিদ হুসাইন তুরি বলেছেন, কুররমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানো এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা জরুরি।
কুররম দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের অন্যতম উত্তপ্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ইতিহাস রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও প্রশাসনিক দুর্বলতার বড় উদাহরণ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংঘর্ষ বন্ধে অবিলম্বে দুই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন একটি সংলাপ আয়োজন করা দরকার। এছাড়া ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
কুররমের সংঘর্ষ যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে এটি খাইবার পাখতুনখোয়ার অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানের ভঙ্গুর রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি আরও বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রশাসনের কৌশল ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই সহিংসতা পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করবে।