বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত বৈশ্বিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই মোট ১১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা আসছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন অর্থ সচিব ড. মো: খায়রুজ্জামান মজুমদার।
অর্থ সচিব জানান, এডিবির সাথে ইতোমধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি নেগোশিয়েশন সম্পন্ন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই এই অর্থ বাংলাদেশের কোষাগারে জমা হবে। একইভাবে বিশ্বব্যাংকের সাথে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আরেকটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, যা একই সময়ের মধ্যে পাওয়া যাবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এ দুটি ঋণের মূল প্রস্তাবিত অঙ্ক ছিল যথাক্রমে ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সাফল্য এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় উভয় সংস্থা এই সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে অর্থ সচিব সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ও সাফল্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।”
বিশ্বব্যাংক ও এডিবির এই অর্থায়ন সরকারের নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থ সচিব আরও জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছে। আগামী ৪ ডিসেম্বর আইএমএফ প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফরে আসবে। তখন এই সহায়তা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে। অর্থ সচিব আশাবাদী যে, এই অতিরিক্ত অর্থ সহায়তাও শিগগিরই পাওয়া যাবে।
সরকার ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের এই ঋণ সহায়তা মূলত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগে ব্যবহার করা হবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: প্রধানত সড়ক, রেলপথ এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় হবে।
জ্বালানি নিরাপত্তা: বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হবে।
সামাজিক খাত: স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে এ অর্থ ব্যবহার হবে।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয়ে কিছুটা স্থবিরতার কারণে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বড় ভূমিকা পালন করবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঋণ সহায়তা বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে তারা এও সতর্ক করেছেন যে, এই ঋণ কার্যকরভাবে ব্যবহার না হলে তা দেশের ঋণ বোঝা বাড়াবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদুল করিম বলেন, “এডিবি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে পাওয়া অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
অর্থ সচিব সংবাদ সম্মেলনে সরকারের ইতিবাচক অবস্থানের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমরা এখনো আশাবাদী যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। এর মাধ্যমে আমরা অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারব।”
এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের এই ১১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই অর্থায়ন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। তবে একইসঙ্গে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই ঋণ সহায়তা শুধু বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।