তাওহিদ হোসেন, বয়স মাত্র ৪০। একসময় ছিলেন উচ্ছল, প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে ঢাকায় এসে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু আজ তার জীবনের গল্প ভিন্ন। ৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়ে হাজারো মানুষের সঙ্গে রাজপথে নামা সেই তাওহিদের জীবনে এখন শুধুই বেদনার ছায়া। রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া তার পা আজও তাকে সেই দিনটির যন্ত্রণা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেদিন বিকেল চারটার সময় উত্তরা পূর্ব থানার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা তাওহিদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না এমন এক দুঃস্বপ্নের জন্য। আচমকা গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলি বিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানে আহত-নিহতের ভিড়ে তিনি পাননি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। শুধুমাত্র ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে তাকে সাত দিন পরে আসতে বলা হয়।
রাস্তায় গাড়ি নেই, তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে বহু কষ্টে দক্ষিণখানের বাসায় ফেরেন তিনি। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে এক পরিচিতের মাধ্যমে পঙ্গু হাসপাতালে যান। ঘটনার পাঁচ দিন পর গুলি বের করা হলেও সেখানেও উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ মেলেনি।
তাওহিদ এখন দক্ষিণখানের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের ফায়দাবাদ এলাকার একটি ভাড়া বাসায় একা থাকেন। তার স্ত্রী শরিফা ও ছোট সন্তান তাহমিদকে জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে তায়েবা গ্রামের মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষটি এখন কাজ করতে পারেন না। এমনকি হাঁটতেও পারেন না ঠিকমতো। ফলে আয় রোজগারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বাসার বাড়িওয়ালারও সামর্থ্য নেই তাকে সাহায্য করার। দুই মাস ভাড়া নেননি তিনি, কিন্তু নিজেই আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় বেশি সহযোগিতা করতে পারছেন না। প্রতিবেশীরাও তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি।
তাওহিদ আক্ষেপ করে বলেন, “রাষ্ট্রের জন্য গুলি খেলাম, কিন্তু আজ অবধি আমার খোঁজ নিতে কেউ আসেনি। চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও করা হয়নি। আজকে বিপ্লবের একশো দিন হয়ে গেল, একটাও মানুষ আমার দরজায় আসেনি। মনে হচ্ছে আপনি প্রথম এবং আপনিই শেষ।”
তিনি আরও বলেন, “যারা শহীদ হয়েছে, তাদের পরিবারকে জামাত দুই লাখ টাকা দিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, না মরে অপরাধ করলাম। মরলে অন্তত আমার পরিবার টাকাটা পেত।”
তাওহিদের মতো একজন সংগ্রামী মানুষের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের নির্লিপ্ততা অনেক প্রশ্ন তোলে। স্থানীয় একজন সমাজসেবক মাইনুল ইসলাম মনিম, যিনি প্রতিবেদককে তাওহিদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন, বলেন, “এমন পরিস্থিতি খুবই কষ্টদায়ক। তাওহিদের মতো যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে, তাদের অন্তত ন্যূনতম চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা দেখছি, রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপ নেই।”
তাওহিদের বাবা-মা টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার উপলদিয়া গ্রামে থাকেন। বৃদ্ধ বাবা নূরুল ইসলাম সামান্য কৃষিকাজ করেন। মা এলি বেগমও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাওহিদের আয়ের উপরই নির্ভর করত পুরো পরিবার। কিন্তু আজ তাদেরও দুর্দশা চরমে।
তাওহিদের স্ত্রী শরিফা জানান, “আমি আর সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। ঢাকায় থাকতে পারি না, কারণ এখানে কোনো আয়ের পথ নেই।”
এই প্রশ্ন তাওহিদের মতো আহত সংগ্রামীদের হৃদয়ে বারবার জাগে। বিপ্লবের এই ফসল কি তাদের জন্য কোনো সুফল নিয়ে আসবে? তাওহিদ মনে করেন, “আমরা যারা নিজেদের উজাড় করে দিলাম, তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই। আমাদের কেউ মনে রাখবে না।”
তাওহিদ চান রাষ্ট্র তার এবং তার মতো আহতদের পাশে দাঁড়াবে। “যদি চিকিৎসা পেতাম, হয়তো কাজ করতে পারতাম। পরিবারকে ভালোভাবে দেখাশোনা করতে পারতাম। এখন কিছুই করতে পারছি না।”
তাওহিদ হোসেনের জীবনের গল্প শুধু তার একার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও সামাজিক নির্লিপ্ততার নির্মম উদাহরণ। এমন সংগ্রামীদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল আচরণ কেবল তাদের জীবনের প্রতি ন্যায্যতা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা। তাওহিদের এই আকুতি কি রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে পৌঁছাবে? নাকি তার মতো আরও অনেক সংগ্রামী এমন করুণ পরিণতির মুখোমুখি হবে? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।