বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ বর্তমানে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। ব্যাংকগুলো নতুন করে ব্যবসা করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় গ্রুপটির বেশ কয়েকটি প্রধান কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির হাজার হাজার কর্মী। পাশাপাশি বাজারেও তৈরি হয়েছে চিনি ও ভোজ্যতেলের সংকট। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম মাসুদ ও তাঁর ছয় ভাই পলাতক। প্রায় এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাঁরা অভিযুক্ত।
গত এক দশক ধরে দেশের সাতটি ব্যাংকের মালিকানায় এস আলম গ্রুপের প্রভাব স্পষ্ট ছিল। গ্রুপটি ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়ে বড় বড় শিল্পপ্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিল। তবে সম্প্রতি ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপের সঙ্গে নতুন করে ব্যবসায় অনীহা প্রকাশ করছে। কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে আপত্তি করছে ব্যাংকগুলো। ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন আর্থিকভাবে চরম সংকটে পড়েছে।
এস আলম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন জানান, ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ না পাওয়ায় চিনি ও ভোজ্যতেলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং এস আলম রিফাইন্ড সুগার লিমিটেড এর কারখানাগুলো বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শত শত শ্রমিক। মোহাম্মদ হোসেন আরও জানান, “শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে আমাদের এখন অনেক কষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে আগ্রহী না হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় টাকা সংগ্রহ করে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে।”
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এহসান উল্লাহ জাহেদী জানান, এস আলম গ্রুপের উৎপাদন বন্ধের কারণে গত ১৫ দিনে চিনির দাম মণপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। একইভাবে, ভোজ্যতেলের দামও এক মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এস আলম গ্রুপের চিনি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এক শ্রমিক জানান, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছি। এখন হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য কোথাও চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপের শীর্ষ নেতৃত্বের পলাতক থাকার কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। এতে গ্রুপটির স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের কারণে ব্যাংকগুলো গ্রুপটির উপর আস্থা হারিয়েছে। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রুপটির অধীনে দুই ডজনেরও বেশি কোম্পানি রয়েছে, যেখানে প্রায় দুই লাখ কর্মী কাজ করেন। গ্রুপটি চিনি, ভোজ্যতেল, ইস্পাত, সিমেন্ট, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। এই সংকট কেবল প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এস আলম গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদকে দ্রুততার সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারের উচিত এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করা, যাতে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন পায় এবং উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা সম্ভব হয়।
এস আলম গ্রুপের বর্তমান সংকট বাংলাদেশের শিল্পখাতের জন্য একটি অশনি সংকেত। ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে না চাইলে এই ধরনের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এর ফলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি বাজারেও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাড়বে। তাই দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।