বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত গাজীপুর সাফারি পার্ক দীর্ঘ তিন মাস দশ দিন বন্ধ থাকার পর আবারও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। পূর্বে এই পার্কটি “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক” নামে পরিচিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার আন্দোলন ও হামলার পর পার্কটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে “গাজীপুর সাফারি পার্ক”। পর্যটন মৌসুম বিবেচনায় এনে পার্কটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এবার পার্কের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে সীমিত পরিসরে।
গত ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার একটি অভ্যুত্থান চলাকালে দুর্বৃত্তরা গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এই পার্কের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা পার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামোতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এর ফলে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ হামলার পরপরই পার্কটি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, হামলার পর পার্কের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষত, প্রাণীদের বসবাসের এলাকাগুলো ও পর্যটকদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন ইভেন্ট স্পট ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর পার্কের ব্যবস্থাপনা ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এটি আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, দীর্ঘ তিন মাসের সংস্কার কাজ শেষে পার্কটি পুনরায় পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা পার্কটি পুনরায় চালু করছি। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে পার্কটি এখনও পুরোপুরি সংস্কার সম্পন্ন হয়নি, তাই সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।”
অন্যদিকে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, “পার্কটি পুনরায় চালু করা হলেও ইজারা প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি। আপাতত বন বিভাগ পার্কটির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে।”
গাজীপুর সাফারি পার্কটি বাংলাদেশে প্রথম এবং বৃহত্তম সাফারি পার্ক হিসেবে পরিচিত। পার্কটির বিস্তীর্ণ এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন বেষ্টনীতে উন্মুক্তভাবে রয়েছে বাঘ, সিংহ, ভালুক, জিরাফ, জেব্রা, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বানর, কুমির, হাতি, ময়ূর, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এই পার্কটি প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণের সুযোগ তৈরি করে দেয়, যা দর্শকদের জন্য এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।
এখানে প্রাণীদের দেখার জন্য দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ ধরনের সাফারি বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। সাফারি বাসে চড়ে দর্শনার্থীরা সুরক্ষিত অবস্থায় বন্যপ্রাণীদের কাছাকাছি যেতে পারেন। এছাড়াও, পার্কে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে ভ্রমণকারীরা। এই পার্কটি শিশুদের শিক্ষামূলক সফরের জন্যও অত্যন্ত উপযোগী।
গাজীপুর সাফারি পার্কটি মোট চার হাজার ৯০৯ একর বনভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ৮১০ একর এলাকাকে সাফারি পার্কের মাস্টার প্ল্যানের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। পার্কের পুনর্গঠন কার্যক্রম চলমান থাকায় কিছু এলাকায় দর্শনার্থীদের প্রবেশ এখনো সীমিত করা হয়েছে। তবে পর্যটন মৌসুমে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে পার্কের কিছু বিশেষ ইভেন্ট ও দর্শনীয় স্থানগুলো পুনরায় চালু করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পার্কটির পুনর্গঠনের পাশাপাশি নতুন কিছু আকর্ষণ যোগ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এছাড়া, পর্যটকদের সুবিধার্থে নতুন ইনফরমেশন সেন্টার, খাবারের দোকান, ও অন্যান্য সুবিধাদি যুক্ত করারও পরিকল্পনা চলছে।
পার্কটি পুনরায় চালু হওয়ার পর দর্শনার্থীদের জন্য কিছু বিশেষ নিরাপত্তা নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। পার্কে প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি সুরক্ষিত এলাকায় অবস্থান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, যেকোনো জরুরি পরিস্থিতির জন্য পার্কে একটি বিশেষ নিরাপত্তা দল মোতায়েন করা হয়েছে।
পার্কটি পুনরায় চালু হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করছেন, এই পার্কটি পুনরায় চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন খাত আবারও চাঙা হবে। পার্কটি বন্ধ থাকার কারণে আশেপাশের ব্যবসায়ীদের আয়-রোজগারে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। এখন পার্কটি খুলে দেওয়ায় তারা আশা করছেন, পর্যটকদের আগমনে আবারও তাদের ব্যবসা উন্নত হবে।
গাজীপুর সাফারি পার্ক নতুন নামে পুনরায় চালু হওয়া নিঃসন্দেহে একটি আনন্দের সংবাদ। এটি কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর পার্কটির পুনরায় চালু হওয়া পর্যটন খাতের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে সামনের দিনগুলোতে পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য কর্তৃপক্ষকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।