বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে দায়ের করা মামলা বাতিল করেছেন। দীর্ঘ সাত বছর পর, অবশেষে বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন। মামলাটি ২০১৬ সালে দায়ের করা হয়েছিল।
আদালতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার চৌধুরী ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী। শুনানি শেষে তিনি জানান, এই মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল এবং এর সঙ্গে আসামিদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইশরাক বলেন, “আমরা আদালতে বলেছি যে, একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে হয়রানি করা হয়েছে। মামলার বিষয়বস্তুর সঙ্গে আসামিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”
তিনি আরও জানান, মামলার বাদী দীর্ঘদিনেও কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। আদালত শুনানির পর বিষয়টি পর্যালোচনা করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন।
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকীর নামে খোলা একটি ফেসবুক পাতা থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করে ব্যঙ্গাত্মক ছবি পোস্ট করা হয়।
এ ঘটনার পর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদের সুজন চট্টগ্রামের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৫৭ ধারায় মামলাটি করা হয়, যেখানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আসামি করা হয়।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আ স ম শহীদুল্লাহ কায়সারের আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তের পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তবে বিএনপির আইনজীবীরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন যে, এই মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান।
এই মামলাটি রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিএনপি দাবি করে, এই মামলাটি ছিল সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত ছিল এবং সেটিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ধারার আওতায় স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয় বলে অনেকেই অভিযোগ করেন।
২০১৬ সালে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাটি করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সরকার বিরোধী দলকে দমনের জন্য আইসিটি আইনকে ব্যবহার করছে। আইনটি তখন থেকেই সমালোচনার মুখে পড়ে এবং ২০১৮ সালে এই আইনটি বাতিল করা হয়।
মামলা দায়ের হওয়ার পর বিএনপির আইনজীবীরা হাইকোর্টে মামলা বাতিলের আবেদন করেন। তাদের বক্তব্য ছিল যে, অভিযোগগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই এবং এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দীর্ঘ সাত বছর পর অবশেষে হাইকোর্ট খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাটি বাতিল করে রায় দেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর (সংশোধিত ২০১৩) ৫৭ ধারা বেশ কিছু বছর ধরে সমালোচনার মুখে ছিল। এই ধারার আওতায় কাউকে “অপমানজনক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শনকারী” তথ্য প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও শাস্তির বিধান ছিল। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ধারাটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের একটি অস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করে আসছিল।
২০১৮ সালে, আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করা হয় এবং নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে নতুন আইনেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার অভিযোগ রয়েছে।
হাইকোর্টের এই রায়ে বিএনপির নেতারা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বিএনপি মনে করে, এই রায় তাদের নেতাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের একটি প্রমাণ। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, আদালত তার স্বাধীন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে এবং এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায় বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, আদালত রাজনৈতিক মামলাগুলোর ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল হওয়া শুধু রাজনৈতিক প্রভাব নয়, বরং আইনের সঠিক প্রয়োগের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে আরও উত্তেজনা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের এবং আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এটি একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই রায়ের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকারকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে।
এই ঘটনাটি বাংলাদেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।