পাকিস্তানে উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলে একটি বিয়ের বাস নদীতে পড়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। বুধবার (১৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা এএফপি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই দুর্ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়েছে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা থেকে একমাত্র নববধূই বেঁচে আছেন বলে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে।
দুর্ঘটনাটি ঘটেছে যখন একটি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাসটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খরস্রোতা নদীতে পড়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরের পরিবার পাঞ্জাব থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে গিলগিটে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বাসে করে অতিথিদের নিয়ে তারা ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। স্থানীয় সময় বিকেলের দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার কর্মকর্তারা।
উদ্ধারকারী কর্মকর্তা ওয়াজির আসাদ আলি জানান, বাসটিতে মোট ২৫ জন আরোহী ছিলেন। দুর্ঘটনার পর নদী থেকে এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তবে এখনও ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এদিকে নববধূকে নদী থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাকে দ্রুত গিলগিটের একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নববধূ বর্তমানে বিপদমুক্ত অবস্থায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
গিলগিট-বালটিস্তানের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা নায়েক আলম এএফপিকে জানিয়েছেন, বাসটি দ্রুতগতিতে চালানোর সময় একটি তীক্ষ্ণ বাঁকে গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে বাসটি সোজা নদীতে গিয়ে পড়ে। পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, নদীর পানির তাপমাত্রা অত্যন্ত কম হওয়ায় উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। নদীর তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকায় নিখোঁজদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে।
দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের জন্য তৎপরতা শুরু করে। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে উদ্ধারকাজে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শীতকালীন মৌসুম শুরু হওয়ায় গিলগিট অঞ্চলে তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে কমে গেছে, যা উদ্ধারকাজকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ওয়াজির আসাদ আলি বলেন, “আমরা এখনও ১০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু পানির প্রবল স্রোত এবং হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা আমাদের কাজকে কঠিন করে তুলছে। তবুও আমরা সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
পাকিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে এবং এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায় সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতা, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলের রাস্তাগুলোতে বাঁকগুলো বিপজ্জনক হওয়ায় এমন দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং চালকদের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে পাকিস্তানে প্রতিবছর অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে শীতকালে বরফঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালানো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই স্থানীয় বাসিন্দারা এবং পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। অনেকেই তাদের প্রিয়জনদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন। নিহতদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা হাসপাতালের সামনে ভিড় করছেন এবং যারা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তাদের সন্ধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।
গিলগিটের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমরা প্রায়ই শুনি এমন দুর্ঘটনার কথা। কিন্তু যখন এমন কিছু নিজের এলাকায় ঘটে, তখন তা আমাদের সবার জন্য একটি বিশাল ক্ষতি।”
এই দুর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলেও রাস্তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য সহায়তার ঘোষণা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
পাকিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়, বিশেষ করে বিয়ের মতো খুশির অনুষ্ঠানের দিন এমন একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা সবাইকে মর্মাহত করেছে। এই ঘটনাটি আরও একবার প্রমাণ করে যে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কতটা জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সড়কগুলোর মান উন্নত করা এবং চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, যাতে ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যায়।