ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। এই রিটটি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ুম। চুক্তিটির শর্তাবলী দেশের স্বার্থ পরিপন্থী ও অসম উল্লেখ করে তিনি এর সংশোধন কিংবা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে রিটটির শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রিট পিটিশনে বলা হয়েছে, ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) যে চুক্তি করেছে তা অসম এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা দেশের জনগণের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। রিটে বলা হয়েছে, “চুক্তির শর্তাবলী ন্যায্য ও সমতার ভিত্তিতে পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। যদি আদানি গ্রুপ তাতে সম্মত না হয়, তবে চুক্তিটি বাতিল করা প্রয়োজন।”
এর আগে গত বুধবার আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ুম পিডিবির চেয়ারম্যান ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। ওই নোটিশে তিন দিনের মধ্যে চুক্তির শর্ত সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। লিগ্যাল নোটিশে উল্লেখ করা হয়, “যদি সংশোধন না করা হয়, তবে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হবে।” চুক্তির সংশোধনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায়, আইনজীবী কাইয়ুম হাইকোর্টে এই রিট পিটিশন দাখিল করেন।
রিটে উল্লেখ করা হয়েছে, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ উচ্চ দামে বিদ্যুৎ আমদানি করছে, যা দেশের আর্থিক ভারসাম্য রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রিটকারির বক্তব্য অনুযায়ী, “চুক্তির শর্তগুলো এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছে যা আদানি গ্রুপের একতরফা সুবিধা নিশ্চিত করে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি।”
চুক্তির প্রেক্ষিতে আরও বলা হয়েছে যে, বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নেই। এ ধরনের চুক্তি দেশের জনগণের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, চুক্তির শর্ত সংশোধন না করা হলে, এটি বাতিল করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন রিটকারী।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় ভারতের ঝাড়খন্ডে অবস্থিত আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই বাংলাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে চুক্তির শুরুর দিক থেকেই এর বিভিন্ন শর্ত, বিশেষ করে বিদ্যুতের মূল্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য যে দামে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশ উচ্চমূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনগণের জন্য আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এই চুক্তির মাধ্যমে আদানি গ্রুপের একতরফা লাভ হচ্ছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করা হয়নি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীরাও এই চুক্তির সমালোচনা করেছেন।
বাংলাদেশ সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাইকোর্টে রিট দায়ের হওয়ার পর সরকারকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে, দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য চাপ আরও বাড়তে পারে।
অনেকেই আশাবাদী যে, হাইকোর্টের এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তির শর্ত সংশোধনের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে আদানি গ্রুপ চুক্তির সংশোধনে রাজি না হলে, আদালতের নির্দেশে এটি বাতিল করা হতে পারে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি করেছে, যার মধ্যে আদানি গোষ্ঠীর চুক্তিটিও অন্যতম। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ আমদানি দেশকে আর্থিক চাপে ফেলছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চুক্তির শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা করলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যয় হ্রাস পাবে এবং দেশের জনগণের ওপর আর্থিক চাপ কমবে। একই সঙ্গে, বাংলাদেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস পায়।
হাইকোর্টে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে। এই রিটের প্রেক্ষিতে যদি চুক্তির শর্ত সংশোধন বা বাতিল করা হয়, তবে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এখন দেখার বিষয়, হাইকোর্ট কী নির্দেশনা দেয় এবং সরকার কীভাবে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।
বিদ্যুৎ খাতে দেশের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে এই রিট একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ন্যায়সঙ্গত ও সমতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক চুক্তি করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।