দেশের পরিবহন খাতে আলোচিত সিদ্ধান্ত হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আজ (১২ নভেম্বর ২০২৪) বেসরকারি খাতে পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় চুক্তির শর্তাবলী যথাযথভাবে না মানার অভিযোগে এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। যদিও বাতিল হওয়া ট্রেনগুলোর তালিকা ও সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
রেলওয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) মো. নাহিদ হাসান খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আজই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে এবং এটি আজ থেকেই কার্যকর হচ্ছে।” তবে কেন এই চুক্তি বাতিল করা হলো, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি তিনি।
রেলওয়ে সূত্রের তথ্যমতে, বাতিল হওয়া ২৪টি ট্রেনের লিজ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালাউদ্দিন রিপন ও তার পরিবারের মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিল। চার বছর মেয়াদে এই চুক্তি হয়েছিল, যার আওতায় বেসরকারি খাত থেকে ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে সরকারের আয়ের উৎস বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে লিজ বাতিলের সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করেনি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ট্রেন পরিচালনার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল। যাত্রী সেবার মান, সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন পরিচালনা না করা, রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা এবং চুক্তির অন্যান্য শর্ত না মানার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের চুক্তি কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়বে। যদিও বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগটি মূলত রেলওয়ের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও সেবার মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, তবে চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
হঠাৎ করে লিজ বাতিলের সিদ্ধান্তে যাত্রীরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে যেসব রুটে বাতিল হওয়া ট্রেনগুলো চলত, সেসব যাত্রীরা এই সিদ্ধান্তের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। যাত্রীরা মনে করছেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল আগে থেকে তাদের অবহিত করা এবং বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, এবং ঢাকা-খুলনা রুটে বাতিল হওয়া ট্রেনগুলোর যাত্রীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অনেকেই জানান, বেসরকারি পরিচালিত ট্রেনগুলোর সেবা মান সন্তোষজনক না হলেও সেগুলো দ্রুতগামী হওয়ার কারণে যাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ লিজ বাতিলের পর কী পদক্ষেপ নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাতিল হওয়া ট্রেনগুলো শিগগিরই সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যাত্রী সেবা উন্নত করা এবং ট্রেনের সময়সূচি সঠিকভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।
বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগটি প্রথমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। রেলওয়ের বিশাল অবকাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে যাত্রী পরিবহন ও আয়ের নতুন সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল। তবে, চার বছরের মেয়াদি চুক্তি থাকা সত্ত্বেও চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
রেলওয়ে খাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, চুক্তি অনুযায়ী মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে বেসরকারি খাতকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে, এই পদক্ষেপ রেলওয়ে ও বেসরকারি খাতের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বেসরকারি ট্রেন পরিচালনা বাতিল হওয়ায় রেলওয়ের রাজস্ব আদায়ে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেন পরিচালনা করে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারীরা এই ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্তে হতাশ হতে পারেন, যা ভবিষ্যতে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী চুক্তি তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে সেবার মান ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে চুক্তির শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বেসরকারি খাতে পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের পরিবহন খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চুক্তি শর্ত মানার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে সেবার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
রেলওয়ের এই সাহসী পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, চুক্তি লঙ্ঘন হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পিছপা হবে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেনগুলো পুনরায় চালু করতে সক্ষম হয়, তবে যাত্রী সেবা ও আয় বৃদ্ধি সম্ভব হবে। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে।