চীনে অর্থনৈতিক মন্থরতা: ভারত-চীনের বাণিজ্য ঘাটতি ৪১ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ
বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের নেতৃস্থানীয় অবস্থান এবং ভারতসহ পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি স্লথ হয়ে পড়েছে, যার ফলে চীনের আমদানির পরিমাণ কমে গেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে ভারতের উপর। ২০২৩ সালে দুই দেশের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যা ৪১ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। এই ঘাটতির মূল কারণ হিসেবে চীনের অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার হ্রাসকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তবে এ ধাক্কা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি একেবারে ভেঙে যায়নি, বরং এটি কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুযোগ সৃষ্টি করেছে। চলুন বিস্তারিতভাবে দেখি চীনের এই অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং তার প্রভাব।
২০২২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকার কারণে বিভিন্ন খাতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ১১টি প্রান্তিকের মধ্যে ৮টি প্রান্তিকেই চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক নিচে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি বড় সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, বাণিজ্যিক দিক থেকে দুই দেশ—ভারত এবং চীন—একটির উপর অন্যটি যথেষ্ট নির্ভরশীল।
চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে, তার আমদানির পরিমাণে ব্যাপক হ্রাস দেখা দিয়েছে, যা ভারতের মতো দেশগুলির উপর প্রভাব ফেলেছে। এই সময়টাতে চীন ভারত থেকে কম পণ্য আমদানি করেছে, যার ফলে ভারতীয় রপ্তানিতে ব্যাপক পতন ঘটেছে। বিশেষত, গত ৬ মাসে ভারত থেকে চীনে রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার কমেছে। এই পরিবর্তন ভারতীয় বাণিজ্যিক অবস্থানকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই ঘাটতির মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারতের চীন-রপ্তানির পরিমাণে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা ৪১ বিলিয়ন ডলার পৌঁছেছে। গত বছরের তুলনায় এই ঘাটতির পরিমাণ ১৪ শতাংশ বেশি, যা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের গুরুতর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। ভারতে আবাসন এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ায়, আকরিক লোহা, গ্রানাইট এবং পাথরজাতীয় পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
ভারতীয় পণ্যগুলির মধ্যে সুতার পণ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনে সুতার চাহিদা হ্রাস পাওয়ার কারণে ভারতের এই সেক্টরে রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। সুতার বাজারে ভারতের বিপুল রপ্তানির পতন চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদার হ্রাসকে একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানোর কারণে, বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা এবং ব্যবহারেও কিছুটা হ্রাস দেখা গেছে। তবে, এ বছর ভারত থেকে চীনে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। এটি একটি আশ্চর্যজনক উন্নতি, কারণ চীনে তেলের চাহিদা কমলেও, ভারত তার পেট্রোলিয়াম রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এই বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতির জন্য কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, চীনে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি এখনও হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও, ভারতের পেট্রোলিয়াম রপ্তানি তাতে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ। তবে, রপ্তানির এই পরিস্থিতি চীন এবং ভারত—এই দুটি দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ঘাটতি কাটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
যদিও চীনের অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং কম চাহিদা ভারতীয় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তবে এই দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং, এই পরিস্থিতি দুই দেশের জন্য নতুন কিছু সুযোগ তৈরি করতে পারে। চীন এবং ভারত—এই দুটি দেশ এখনও একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ভারতে চীনের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে, তবে চীনে ভারতের পণ্য রপ্তানির জন্য অন্য বাজার খুঁজে বের করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
যতদিন না চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার হচ্ছে, ততদিন ভারতে পণ্য রপ্তানির সমস্যা থাকবে। কিন্তু ভারত তার শক্তি ব্যবহার করে নতুন বাজারের দিকে নজর দিলে, তার রপ্তানি সংকট কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হতে পারে। চীনে ভারতের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আশা করা কঠিন।
চীনের ধীর গতির অর্থনীতি এবং ভারতের রপ্তানি হ্রাস সত্ত্বেও, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের আস্থা মোটেও ক্ষুণ্ন হয়নি। ভবিষ্যতে, ভারত চীনের বাজারের উপর কম নির্ভরশীল হয়ে উঠবে এবং দুই দেশ নতুন নতুন বাণিজ্যিক সুযোগ খুঁজে বের করবে। তবে ভারতের জন্য চীনকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য নতুন কৌশল এবং বাজারে প্রবেশের প্রয়োজন হবে।