জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রার রেকর্ড উষ্ণতা: জাপানের ফুজি পর্বতে দেরিতে তুষারপাতের প্রভাব
জাপানের ফুজি পর্বতে দীর্ঘ ১৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বরফের অনুপস্থিতির পর অবশেষে তুষারপাত হয়েছে। জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ায় এ দেরিতে তুষারাবৃত হওয়া এবং দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রার এই গ্রীষ্মকালের প্রভাব নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিবিসি এবং এএফপির তথ্য অনুযায়ী, এই বছরটি গত বছরের তুলনায় বরফ পড়ায় সবচেয়ে বিলম্বিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশটির আবহাওয়া সংস্থার শিজুওকা শাখা বুধবার ফুজি পর্বতের তুষারাবৃত চূড়া প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করে।
প্রত্যেক বছরই শীতের শুরুতে ফুজি পর্বতের চূড়ায় তুষারপাত দেখা যায়। সাধারণত অক্টোবরের শুরুতেই বরফে আবৃত থাকে এই চূড়া। তবে এই বছর এক মাস বিলম্বের পর চূড়ায় বরফ পড়ার সংবাদ স্থানীয় জনগণের মাঝে ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। শীতকালীন এই তুষার দৃশ্যের প্রত্যাশায় ছিল সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্থানীয়রা সাদা চূড়ার ছবি শেয়ার করে তাদের আনন্দ প্রকাশ করেছে। এক্স (সাবেক টুইটার) এর ব্যবহারকারীরা এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, “অপেক্ষা করে ছিলাম,” এবং “এই সাজে তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে।”
কোফু শহরের আবহাওয়া সংস্থাও বৃহস্পতিবার ফুজি পর্বতের চূড়ায় তুষারপাত নিশ্চিত করেছে। যদিও বুধবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে চূড়ার তুষারপাত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, পরের দিন সকালেই এই তুষারাবৃত দৃশ্য দৃশ্যমান হয়।
জাপানে এ বছরের গ্রীষ্ম ছিল রেকর্ডকৃত অন্যতম উষ্ণ গ্রীষ্ম। জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশটির তাপমাত্রা গড়পড়তার চেয়ে প্রায় ১.৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ২০০৩ সালের পর এটি ছিল জাপানের সবচেয়ে গরম গ্রীষ্মকাল। এমনকি সেপ্টেম্বরে এসেও উষ্ণ আবহাওয়া বজায় ছিল, যা সাধারণ শীতের শুরুর তুলনায় অনেক বেশি। উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে তুষারপাত দেরিতে দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা সরাসরি এই দেরিতে তুষারপাতের ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত করতে না পারলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আবহাওয়ার প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তা এর পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে শীতের আগমনে তুষারপাতের সময়েও বিলম্ব দেখা দিতে পারে।
জাপানের এই দীর্ঘ বরফহীন পর্বত এবং উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এই ধরনের উষ্ণ আবহাওয়া এবং তুষারপাতের বিলম্ব আরও ঘন ঘন হতে পারে।
ফুজি পর্বত জাপানের অন্যতম পরিচিত প্রতীক এবং সাংস্কৃতিক আইকন। শত শত বছর ধরে এটি শিল্প ও সাহিত্যে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। এই পর্বতটি টোকিওর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং এর উচ্চতা প্রায় ১২,৪৬০ ফুট। এটি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, যা প্রায় ৩০০ বছর আগে শেষবার অগ্ন্যুৎপাত করেছিল। পরিষ্কার দিনে এই সাদা চূড়াটি টোকিও থেকেও দেখা যায়, যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য বিশাল আকর্ষণ।
এই বছর তুষারপাতের দেরিতে আসার ঘটনা ২০২৩ সালের পর আবারও রেকর্ড সৃষ্টি করলো। ২০২৩ সালে প্রথম তুষার দেখা গিয়েছিল ৫ অক্টোবর, যা ১৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দেরিতে বরফ পড়ার ঘটনা ছিল। এর আগের রেকর্ড ছিল ২৬ অক্টোবর, যা ১৯৫৫ এবং ২০১৬ সালে হয়েছিল। চলতি বছর আরও বেশি দেরিতে তুষারপাত শুরু হওয়া নতুন জলবায়ু বাস্তবতা এবং আবহাওয়ার বৈচিত্র্যের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য একটি সতর্কতা স্বরূপ।
জাপানে ফুজি পর্বতের এই দেরিতে তুষারপাত সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংযুক্ত করা না গেলেও ভবিষ্যৎ জলবায়ুর বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনের দিকে আমাদেরকে ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের ঘটনা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা, কৃষি এবং পর্যটন খাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এই ধরনের দীর্ঘ বরফহীন পর্বতের ঘটনা আরও ঘন ঘন হতে পারে, যা বিশ্বের অন্যান্য বরফাবৃত পর্বতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।