চলনবিলে অতিথি পাখি শিকারে বেপরোয়া মনোভাব, আইনের প্রয়োগ অনুপস্থিত
শীতের আগমনে দেশের অন্যতম অতিথি পাখিদের আবাসস্থল সিরাজগঞ্জের চলনবিলের চারপাশে আবারও অতিথি পাখির দেখা মিলছে। স্থানীয়দের জন্য এটি এক স্বস্তির বিষয় হলেও শিকারিদের অবাধ দৌরাত্ম্যে পাখিদের জীবন হুমকির মুখে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের শিথিল প্রয়োগের কারণে এই অঞ্চলে শিকারিদের জন্য যেন এক উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি হয়েছে। নিয়মিত অভিযান ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় শীতের শুরুতেই বিলজুড়ে পাখি শিকার বেড়ে গেছে।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শীতল এলাকা থেকে অতিথি পাখিরা খাবার ও আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসে। চলনবিল অঞ্চলে পুঁটি, দারকিনা, খলসে ইত্যাদি মাছ এবং পোকামাকড়ের প্রাচুর্য থাকায় পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয়। চলনবিলের বড় এক আকর্ষণ হচ্ছে শামুকখোল, বালিহাঁসসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখি, যারা এ সময় প্রচুর পরিমাণে আসে এবং বিলের পরিবেশে প্রাণ সঞ্চার করে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও অতিথি পাখিরা শিকারির জালে বন্দি হচ্ছে।
প্রতিদিন ভোরে চলনবিলের কুন্দইল, দিঘীসগুনা, বস্তুল এবং পঁওতা বাজারে শিকারিদের বাজার বসে। পাখি শিকারিরা রাতভর অতিথি পাখি শিকার করে এই বাজারগুলোতে এনে বিক্রি করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, শীতের সময় অতিথি পাখির ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিদিন শতশত বক, হাঁস ও অন্যান্য পাখি বিক্রি হয়। শিকারিরা কম পরিশ্রমে পাখি ধরে বিক্রি করে ভালো লাভ করতে পারেন বলে অনেকেই এই কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছেন।
অনেক শিকারিরা মনে করেন, পাখি শিকার কার্যত অবৈধ হলেও আইন কার্যকর না হওয়ায় তেমন সমস্যা নেই। পাখি বিক্রির মাধ্যমে তারা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান, এবং বাজারে পাখির চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় শিকারিরা অনায়াসে তাদের ক্রেতাদের কাছে পাখি পৌঁছে দেন। কিছু ক্রেতা এমনকি শিকারিদের বাড়িতে গিয়েও পাখি কিনে আনেন। অনেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাখি শিকারের ছবি পোস্ট করেন, যা এই অবৈধ কাজকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলছে।
২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, যে কেউ অতিথি পাখি শিকার করলে তাকে সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। একই অপরাধ পুনরাবৃত্তি হলে শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। অথচ, এই আইন থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত অভিযান বা প্রচারণার অভাবে শিকারিরা নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা ইসলাম মনে করেন, চলনবিলে পাখি শিকারের কারণে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি বলেন, “বিলের অতিথি পাখি বেঁচে থাকার জন্য পোকামাকড় ও ছোট মাছ খেয়ে থাকে, যা এখানকার বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। যদি অতিথি পাখির শিকার চলতে থাকে, তাহলে পুরো বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে।”
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির তাড়াশ উপজেলা শাখার আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, “আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এই শিকারিদের থামানো যাবে না। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইন মেনে অতিথি পাখিদের রক্ষা করার জন্য জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।”
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুইচিং মং মারমা বলেন, “পাখি শিকারিদের অবস্থান জানা গেলে আমরা অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” তিনি আরও জানান যে, বিশাল চলনবিলে সবসময় নজরদারি করা কষ্টকর হলেও জনসচেতনতা বাড়াতে প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারে।
উপজেলা বন কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, “রাতে শিকারিদের সন্ধান পাওয়া কঠিন। তবে যদি স্থানীয় মানুষ সচেতন হয় এবং শিকারিদের তথ্য সরবরাহ করে, তাহলে তাদের ধরতে আরও সহজ হবে।” তিনি বলেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও পরিবেশগত সংগঠনের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
আইন প্রয়োগের পাশাপাশি চলনবিল এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা কার্যক্রমের প্রয়োজন। পাখি শিকার রোধে বিলজুড়ে লোকজনকে সচেতন করতে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি চালানো যেতে পারে। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো গেলে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর গুরুত্ব বোঝানো সম্ভব হবে।
এছাড়া স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোতে অতিথি পাখি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এলাকার অন্যান্য মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো যেতে পারে। এতে শিকারিরা ও ক্রেতারা এই শিকারকে অপরাধ হিসেবে বুঝতে পারবেন এবং ভবিষ্যতে পাখি শিকার কমবে বলে আশা করা যায়।
চলনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অতিথি পাখিদের রক্ষার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রশাসন, পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠন ও স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই বিলের পাখি শিকারিরা বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে চিরতরে বিপন্ন করতে পারে।