বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের চার নেতাকে গুম ও নির্যাতনের পর পঙ্গু করার অভিযোগে র্যাব, ডিবি, ও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভুক্তভোগী চার নেতা এই অভিযোগ দায়েরের সময় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
অভিযোগে উল্লেখিত চার শিবির নেতা হলেন— মো. আবুজর গিফারী, ওমর আলী, মো. রুহুল আমিন, এবং ইস্রাফিল হোসেন। আবুজর গিফারী ছিলেন জয়পুরহাট জেলা শিবিরের তৎকালীন সভাপতি, ওমর আলী জেলা সেক্রেটারি, রুহুল আমিন চৌগাছা উপজেলা শিবিরের সাহিত্য সম্পাদক, এবং ইস্রাফিল হোসেন একই থানার সেক্রেটারি। এই নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, গুম করার পর রাতের আঁধারে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের হাঁটুর নিচে গুলি করা হয়, যার কারণে তাদের পা ঝাঝরা হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়।
আবুজর গিফারী এবং ওমর আলীর ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। অভিযোগ অনুসারে, জয়পুরহাট থেকে ঢাকায় শিবিরের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে যাওয়ার পথে তাদের সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে তাদের ওপর দীর্ঘ সময় অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে পুনরায় নির্যাতনের পর তাদের জয়পুরহাটের নির্জন এলাকায় নিয়ে পায়ে গুলি করা হয়।
একইভাবে, ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে যশোর জেলার রুহুল আমিন ও ইস্রাফিল হোসেনকে তাদের সংগঠন সংক্রান্ত কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেফতার করা হয়। চৌগাছা থানার ডিবি অফিসে দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন শেষে তাদেরও গভীর রাতে বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে নিয়ে গিয়ে একই পদ্ধতিতে গুলি করা হয়।
মামলা দায়েরের পর ছাত্রশিবিরের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান জানান, বর্তমান সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা ক্রমান্বয়ে এসব ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করব।” অভিযোগে তারা দাবি করেন, এই সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
ভুক্তভোগী নেতা আবুজর গিফারী বলেন, “পায়ে গুলি করার পর আমাদের শুধুমাত্র ড্রেসিং করা হয়েছিল, উন্নত চিকিৎসা না দেওয়ায় পায়ে পচন ধরে যায়। অবশেষে ঢাকার একটি হাসপাতালের ডাক্তার আমাদের পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন।” চিকিৎসার দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও কারাগারে স্থানান্তরিত হওয়ার স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি জানান, “এটা শুধু আমাদের সঙ্গে নয়, এমন অনেক শিবির নেতা ও কর্মীর সঙ্গেই এমন ঘটেছে।”
অভিযোগকারী নেতাদের দাবি অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রশিবিরের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্যাতন, গুম ও নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটেছে এবং তা শাসনক্ষমতার অপব্যবহার ও ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্বমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে দাবি করা হচ্ছে। অভিযোগে জয়পুরহাট ও যশোর জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনতার পর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীনদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়েরের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি এই ধরণের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের আহ্বান জানিয়েছে।
এই মামলার মাধ্যমে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এই ধরনের ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এই মামলা দেশের বিচারিক ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায় তৈরি করতে পারে, যা মানবাধিকার রক্ষায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।