বিশ্ব ইজতেমা বিতর্ক: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী মহাসম্মেলনে সরকারের প্রতি কড়া বার্তা
বাংলাদেশে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ইসলামি মহাসম্মেলনে ভারতীয় আলেম মাওলানা সাদের বাংলাদেশে আগমন নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন তাবলিগ জামাতের সাধারণ সাথী ও কওমি আলেম-ওলামারা। মাওলানা জোবায়েরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এ দলটি মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, মাওলানা সাদকে দেশে আসতে দেয়া হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে চরম মূল্য দিতে হবে।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মাওলানা আব্দুল হামিদ (পীর মধুপুর), জামেয়া হোসাইনিয়া মিরপুর মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া এবং বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। আলেমরা সতর্ক করে বলেন, সরকার যদি মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়, তবে তাদেরকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।
মাওলানা আব্দুল হামিদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, “বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে সরকার দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করতে চাইছে, কিন্তু আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট: এই সম্মেলন থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বাইরে কোনো পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।”
মাওলানা হামিদ আরও বলেন, “সরকারকে অবশ্যই আলেমদের সহযোগিতা করতে হবে, নয়তো পূর্ববর্তী সরকারের মতোই তাদেরও দেশ ছাড়তে হতে পারে। যদি ‘বেয়াদবকে’ বাংলাদেশে আসতে দেয়া হয়, তাহলে সরকারকেও পালিয়ে যেতে হবে।” আলেমদের দাবি, মাওলানা সাদের অনুসারীরা ইজতেমায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং এতে বাংলাদেশে তাবলিগের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া বলেন, “মাওলানা সাদকে আনার কোনো ষড়যন্ত্র হলে, তিনি যেদিক দিয়েই আসবেন সেদিক দিয়ে লংমার্চ শুরু হবে। আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার: যেকোনো মূল্যে তাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধা দিতে হবে।” এই বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে আলেমদের সমাবেশে উপস্থিত সাথীরা কঠোর প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি দেন।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, “মাওলানা সাদ ও তার অনুসারীরা বিশ্ব ইজতেমায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। তাদের কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া হবে না। ইসলামী জনতাকে বিভ্রান্ত করার যে কোনো চেষ্টা আমরা ব্যর্থ করবো।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এই বিষয়ে সরকারকে তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাস প্রায় ৫৮ বছরের পুরোনো। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ হিসেবে পরিচিত। তবে ২০১৯ সালে মাওলানা সাদ এবং কাকরাইলের মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়, যা ইজতেমার ঐতিহ্যে বড় ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীতে, দুই পক্ষের মধ্যে ইজতেমা আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা দেখা দেয়।
কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে ইজতেমা বন্ধ ছিল। তবে ২০২২ সাল থেকে ইজতেমা আবার দুই পর্বে আয়োজিত হচ্ছে। তবে এবারও মাওলানা সাদ ও মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা আলাদা পর্বে ইজতেমা পালন করবেন।
সোমবার (৪ নভেম্বর) একটি বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আগামী বছরও বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, আর দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে এখনও নির্দিষ্ট হয়নি কোন পক্ষ কোন পর্বে ইজতেমা পালন করবে।
বৈঠকে মাওলানা সাদের অনুসারীরা তাদের দাবি উত্থাপন করেন এবং প্রথম পর্বে ইজতেমা আয়োজন করতে আগ্রহী বলে জানান। তবে মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না এবং তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত পরবর্তী দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়ে দেন।
সম্মেলন থেকে আলেম-ওলামারা স্পষ্ট করে বলেন, “আজকের ইসলামি মহাসম্মেলন থেকে যে সিদ্ধান্ত এসেছে, সরকারকে তা মেনে চলতে হবে। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত তৌহিদী জনতা মেনে নেবে না।” উপস্থিত আলেমদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যাতে তারা তাবলিগের এই ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠকে গুরুত্ব দেয় এবং বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়।
এই সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য এবং হুঁশিয়ারিগুলো একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে, বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করছে এবং সরকারকে এর সমাধানে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।