বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ একটি প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের তিনটি দেশ থেকেই এসেছে মোট রেমিট্যান্সের ৪৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে, যা অর্থনীতিবিদদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পেছনে ফেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে শীর্ষে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার ২০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুলাই মাসে ২৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠানো হয়, আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে। সেপ্টেম্বরে যদিও এই পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলারে পৌঁছায়, তবে অক্টোবর মাসে তা আবার বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ কোটি ডলার পর্যন্ত ওঠে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী রেমিট্যান্স উৎস
রেমিট্যান্স প্রবাহে সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে শীর্ষে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই দেশ থেকে ১৩৬ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ১৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে, যা আগস্টে বেড়ে ৩৪ কোটি ডলারে পৌঁছায়। সেপ্টেম্বরে তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়, তবে অক্টোবর মাসে কিছুটা কমে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। এই ধারাবাহিক রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশটির অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
সৌদি আরব: রেমিট্যান্স প্রবাহে তৃতীয় অবস্থানে
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সৌদি আরব রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সৌদি আরব থেকে মোট ১১৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার বা ১৪ হাজার ১১৩ কোটি টাকা সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে।
এই সময়ে সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ স্থিতিশীল থাকলেও মাসভিত্তিক প্রাপ্তি কিছুটা ওঠানামা করে। তবে অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশের তুলনায় সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। প্রবাসী আয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তা করে। এর ফলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এবং গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরকারও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এবং এই খাতে নীতি সহায়তা প্রদান করছে।
কেন যুক্তরাষ্ট্রে রেমিট্যান্স প্রেরণ শীর্ষে?
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত তুলনামূলক বেশি আয়ের অধিকারী। অধিকাংশ প্রবাসী উচ্চশিক্ষিত এবং ভালো চাকরিতে নিয়োজিত, যার ফলে তারা নিয়মিত এবং অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী থাকায় এই দেশটি রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিরা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত, যা দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের একটি বিশাল অংশ নিশ্চিত করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশ হিসেবে রয়েছে, এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের প্রভাব আরো বাড়তে পারে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে, শ্রম বাজারের বৈচিত্র্য আনতে এবং অন্যান্য দেশেও শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়া উন্নত করতে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদন রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহের গুরুত্বকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কর্মসংস্থান এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করছে।