দেশের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এক মামলার অবসান ঘটালো হাইকোর্ট। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বাতিল করেছেন আদালত।
আজ বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মামলার শুনানি শেষে দু’টি মামলাই বাতিল করেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি বাতিলের আদেশে আদালত উল্লেখ করেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা আইনত বৈধ নয়। মামলাটি দায়েরের সময় পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের অনুমতি না নেয়ায় আদালত তা বাতিল করেছেন।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি তারেক রহমান লন্ডন থেকে একটি বক্তব্য প্রদান করেন, যা সরাসরি সম্প্রচার করে ইটিভি। পরদিনই পুলিশ অভিযোগ করে যে, তারেক রহমানের সেই বক্তব্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করেছে এবং দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকে দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের জন্য তেজগাঁও থানা পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর, ওই বছরের ৮ জানুয়ারি এই মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় আসামি হিসেবে তারেক রহমান ও আব্দুস সালামের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মামলা দায়েরের পর থেকেই এটি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিশেষ করে বিএনপি এবং সমর্থক মহলে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পায়। এই মামলায় আব্দুস সালাম দীর্ঘদিন কারাগারে আটক থাকেন। তবে, মামলার পক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেন যে, অভিযোগটি ভিত্তিহীন এবং এর মাধ্যমে সরকারের মতের বিরোধীদের দমন করা হচ্ছে।
বিচারিক প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে, মামলার আবেদনকারীরা আদালতে যুক্তি দেন যে, এ ধরনের মামলা দায়ের করতে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন, যা এখানে অনুসরণ করা হয়নি। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা এ মামলার বিরোধিতা করলেও আদালত শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বাতিলের রায় দেন। হাইকোর্টের এ রায়ে বিএনপি শিবিরে স্বস্তি দেখা গেছে, এবং এই রায়কে তারা ‘ন্যায়বিচার’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা বাতিলের এই রায় দেশে আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার সমর্থিত মামলা হওয়া সত্ত্বেও আদালতের এমন রায় প্রমাণ করে যে, দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে। এ ধরনের রায় ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা মোকাবেলায় একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে এই রায়কে একটি বড় বিজয় হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এবং তারা দাবি করেছে, এটি প্রমাণ করে যে বর্তমান সরকার বিরোধী দলের ওপর জুলুম করছে। অন্যদিকে, সরকার পক্ষের নেতারা বলেছেন, তারা হাইকোর্টের রায়কে সম্মান জানালেও এ বিষয়ে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
এই মামলার এমন পরিণতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই রায় বিএনপির জন্য রাজনীতির মাঠে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে, ভবিষ্যতে তারেক রহমানের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে এটি সহায়ক হতে পারে।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অভিযোগে ইটিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালামকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী থাকার পর তার জামিন মঞ্জুর হলেও এই মামলার ফলে তার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মামলাটি বাতিল হওয়ার ফলে সালাম এবং তার পরিবার আশ্বস্ত হয়েছেন।
হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বলছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরকম রায় ভূমিকা রাখবে। ইটিভির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা সবসময় সংবাদ প্রচারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন এবং আদালতের এই রায়ে তারা খুশি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা এবং সেই মামলার পরিণতি নিয়ে সাধারণ জনগণ সবসময়ই আগ্রহী। এই রায় একদিকে যেমন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তেমনি আদালতের এই নির্দেশনা গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।