বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে গত সাড়ে তিন বছরে সবচেয়ে বড় দরপতন ঘটেছে, যা অর্থনীতি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রবিবার (২৭ অক্টোবর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯.২০ পয়েন্ট বা ২.৯১ শতাংশ কমে ৪৯৬৫.৩৯ পয়েন্টে নেমে আসে। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের পর এই পতন শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় আঘাত বলে মনে করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শত শত বিনিয়োগকারী মতিঝিলে ডিএসই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন।
গত কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে নানা ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ, অস্থায়ী ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থাসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের কারণেও বাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, গত ১৫ বছরের অনিয়ম ও দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলিকে তালিকাভুক্ত করাও একটি কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। তারা জানায়, এই দুর্বল কোম্পানিগুলি কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারদর বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এবং ফ্লোর প্রাইসের মতো কৃত্রিম ব্যবস্থা দিয়েও এই পতন রোধ করা সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকার শেয়ারবাজারে ডিএসইএক্স সূচকটি ১৮১ পয়েন্ট কমে ৫০৮৯ পয়েন্টে নেমেছিল এবং ২০২২ সালের ৭ মার্চ সূচকটি ১৮২ পয়েন্ট হারিয়ে ৬৪৫৬ পয়েন্টে পৌঁছায়। এই দুই ঘটনা শেয়ারবাজারের অস্থিরতার নজির হয়ে রয়েছে। তবে পয়েন্ট বিবেচনায় সর্বোচ্চ পতন হলেও শতাংশের ভিত্তিতে বর্তমানে ঘটেছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ হ্রাস।
এবারের দরপতনে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২৭ অক্টোবরের দরপতনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৯৭টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৩৯টি প্রতিষ্ঠানই শেয়ার মূল্যে পতনের শিকার হয়। কমপক্ষে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১৫৯টি কোম্পানি। এই ক্ষতির পর বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ। রাজধানীর মতিঝিলের ডিএসই পুরানো ভবনের সামনে কয়েকশ বিনিয়োগকারী বিক্ষোভ করেন এবং দ্রুত সমাধানের দাবি জানান।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিএসইসির দাবি, বাজারে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে তারা ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অতীতের দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলি তালিকাভুক্ত করার পর তাদের শেয়ার মূল্যে কারসাজির দিকেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
শেয়ারবাজারের এই ধস জাতীয় অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া মানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বাড়ছে। আর্থিক বাজারে এমন অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা কমিয়ে দেয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি বাড়িয়ে তোলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শক্তিশালী শেয়ারবাজার গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বারংবার পতনের কারণে এই বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে।
বাজারের এই অবনতির পটভূমিতে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং আস্থা অর্জনের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। দুর্বল কোম্পানিগুলিকে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে কঠোর যাচাই-বাছাই এবং বাজারে কারসাজি রোধে শক্তিশালী তদারকির দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় আরও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
এতদূর পতনের পর শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নীতি প্রণেতা ও নিয়ন্ত্রকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কোম্পানির মূল্যায়ন, ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থার পর্যালোচনা এবং বাজারের আস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করাও জরুরি।
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক দরপতন বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব।