রাজশাহী শহরে দুর্বৃত্তদের আক্রমণে যুবলীগের এক কর্মী মীম (২৭) ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। শনিবার (২৬ অক্টোবর) রাতে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে অজ্ঞাতপরিচয় কিছু ব্যক্তিরা তাকে হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মীমের মৃত্যু ঘটে।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যার পর, মীমকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে মীমকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালের সামনে রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এর পরপরই হাসপাতালের কর্মীরা মীমকে জরুরি চিকিৎসা দেন, কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
নিহত মীম রাজশাহী শহরের রামচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে যুবলীগ কর্মী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় রাজশাহী মহানগর যুবলীগ নেতা রুবেলের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। গত ৫ আগস্টে হওয়া এই আন্দোলনের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, যেখানে গুলি চলার ঘটনাও ঘটে। পরে সেই মামলায় রুবেলসহ কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
নিহতের সাথে সম্প্রতি কারো সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব বা পূর্ব শত্রুতা ছিল কি না তা নিয়ে পুলিশ এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়নি। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মীমের হত্যা রহস্য উদঘাটনে তারা বিভিন্ন দিক থেকে তদন্ত শুরু করেছেন। পূর্বের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত শত্রুতা কিংবা গোপন কোনো আর্থিক লেনদেনের বিষয়গুলো তারা খতিয়ে দেখছেন।
পুলিশ ইতোমধ্যে মীমের পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। তবে নিহত মীমের পরিবার জানিয়েছে যে, সম্প্রতি মীম কারও সঙ্গে বিশেষ কোনো দ্বন্দ্বে জড়াননি। তবে তার কিছু বন্ধু জানিয়েছেন, মীম গত কয়েকদিন ধরে কিছু অজানা মানুষের ফোন কল পেয়ে আসছিলেন এবং তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
মীমের মৃত্যুর পর যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তারা দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন এবং বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রাজশাহী যুবলীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “মীম একজন পরিচিত যুবলীগ কর্মী ছিলেন এবং তার ওপর এমন বর্বরোচিত আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
এছাড়া, মীমের মৃত্যুর পর রামচন্দ্রপুর এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তারা বলছেন, সম্প্রতি এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে যে, মীম হত্যার তদন্তে তারা বিশেষ টিম গঠন করেছেন এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন। তারা আশা করছেন, শীঘ্রই এই হত্যার পেছনের মূল রহস্য উদঘাটন করা যাবে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি এবং বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। খুব শিগগিরই হত্যার মোটিভ এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হবো।”
এই হত্যাকাণ্ডের পর রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে কয়েকটি সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অপরাধ দমনে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন, যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে।
এ ঘটনার পর রাজশাহীর রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন উঠেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, মীম হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কোনো কারণ থাকতে পারে। বিশেষ করে, মীমের সহযোগী রুবেলের গ্রেফতার এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিহত মীমের পরিবার ও এলাকাবাসী শোকে মুহ্যমান। মীমের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানায়, “মীম সবসময় হাসিখুশি ছিল এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সমাজসেবায়ও জড়িত ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।” তার পরিবারও বলেছে যে, মীমের অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যু তাদের জীবনে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
মীম হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করার জন্য সকল পক্ষকেই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সমাজে সুষ্ঠু ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত এবং বিচার ব্যতীত এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত শোকের ঘটনায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার একটি উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে।
—