বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্প্রতি নতুন পদ সৃষ্টি নিয়ে শিক্ষক সমাজে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেতন গ্রেড বৃদ্ধি না করায় এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক পদটি চালু করার পরিকল্পনার ফলে এই অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপ শিক্ষকদের মধ্যে নতুন করে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন এবং বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া না হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জাতি গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
শিক্ষকদের বেতন ও পদন্নোতি নিয়ে অসন্তোষ
একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে আট বছর ধরে কাজ করার পরেও তাঁদের পেশাগত উন্নতি কিংবা পদন্নোতির সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করেন অনেক শিক্ষক। ১৩ গ্রেডের বেতনে থাকা শিক্ষকরা প্রায় ২৪ হাজার ৪৪২ টাকা মাসিক বেতন পান, যা বর্তমান জীবনের মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে তাঁরা মনে করেন। শিক্ষকদের অভিযোগ, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি বারবার উপেক্ষা করা হচ্ছে। অথচ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিম্নস্তরের কর্মচারীরা যেমন চালক, কম্পিউটার অপারেটর, সাঁটলিপি অপারেটররা উচ্চ গ্রেডের বেতন পাচ্ছেন। একজন চালকও বর্তমানে ১২ গ্রেডের বেতন পাচ্ছেন, অথচ শিক্ষকরা ১৩ গ্রেডে থেকেও একই সুবিধা পাচ্ছেন না। এতে করে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন।
সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির বিরোধিতা
বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের দাবি, এই পদ সৃষ্টির ফলে তাঁদের পদন্নোতি পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে হারিয়ে যাবে। কারণ প্রধান শিক্ষকের পদে সরাসরি পিএসসি (বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন) থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে সহকারী শিক্ষকরা আর এই পদে উত্তীর্ণ হতে পারবেন না। ফলে শিক্ষকরা মনে করছেন, অভিজ্ঞ সহকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করে অনভিজ্ঞ সহকারী প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হবে, যা পেশাগত মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শিক্ষকদের প্রতি অসম আচরণের অভিযোগ
শিক্ষক সমাজের একটি বিশাল অংশ মনে করেন, সরকার তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। তাঁরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বেতন গ্রেড বৃদ্ধির দাবিও তুলেছেন, কিন্তু তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এর পরিবর্তে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে আরও নতুন বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, যা শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব এবং সম্মানের ওপর আঘাত হানবে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন।
শিক্ষকরা মনে করছেন, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন না করা হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার মানে ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাঁরা বলেন, শিক্ষকেরা ভালো থাকলে সমাজে সুনাগরিক তৈরি হবে, কিন্তু যদি তাঁদের বেতন, পদন্নোতি, এবং সম্মানজনক পেশাগত জীবন নিশ্চিত করা না হয়, তবে শিক্ষাব্যবস্থা মেধাশূন্য হয়ে পড়বে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের দাবি, সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে অন্তত তিন লাখ শিক্ষক এবং তাঁদের পরিবারকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাঁদের মতে, শিক্ষাব্যবস্থায় মানোন্নয়নের মাধ্যমেই একটি দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং দেশের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উন্নতি ঘটবে। তাই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আরও গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষকদের আশঙ্কা
বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির কারণে শিক্ষকদের মধ্যে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তা শুধুমাত্র পেশাগত অবস্থানের কারণে নয়, বরং তা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও তাঁরা মনে করছেন। শিক্ষকদের মতে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের পেশাগত মান, বেতন, এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা না হলে আগামী দশ বছরে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সমাজে নীতি-নৈতিকতার অভাব দেখা দেবে।
শিক্ষক সমাজের দাবি, তাঁদের পেশাগত উন্নয়ন এবং বেতন বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে তাঁরা দেশের জন্য আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারেন।