উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার (২২শে অক্টোবর) এক বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায় যে, নীতি সুদহার বা রেপো রেট দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর আগে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই সিদ্ধান্ত আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথে আরও এগোচ্ছে। মূলত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ কমাতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে পূর্বের তুলনায় বেশি সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের খরচ বাড়বে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং তার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর। বিশেষ করে যারা নতুন ঋণ নিতে চান, তাদের জন্য ঋণের সুদহার বেড়ে যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে মূলত চায় অর্থনীতিতে অতিরিক্ত নগদ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কারণ, বেশি টাকা বাজারে থাকলে তা ব্যয়ের মাধ্যমে সরাসরি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যবসা ও বিনিয়োগের খরচ বাড়বে, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও খরচের প্রবণতা কিছুটা কমবে এবং এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ১১ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সীমিত সময়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উচ্চ হারে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করবে, যা তাদের জন্য খরচের বোঝা আরও বাড়াবে।
অপরদিকে, নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহারও ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য তাদের অতিরিক্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করবে, কারণ জমার ওপর তারা বেশি সুদ পাবে। ফলে বাজারে অতিরিক্ত অর্থের সরবরাহ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম, আমদানি ব্যয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথে হাঁটছে। অর্থনৈতিকভাবে সংকটময় পরিস্থিতিতে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানোই একমাত্র উপায় নয়, তবে এটি মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করতে পারে।
নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে যে, ক্রেডিট প্রবাহ কিছুটা কমবে এবং খরচের পরিমাণও কিছুটা কমবে। এ পদক্ষেপের ফলে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, যা সাধারণ মানুষ এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত সরাসরি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর প্রভাব ফেলবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের সুদহার পুনর্নির্ধারণ করতে হতে পারে, যা গ্রাহকদের জন্য ঋণ গ্রহণে অতিরিক্ত খরচের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে ব্যবসায়িক ঋণ ও ব্যক্তিগত ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়লে উদ্যোক্তাদের খরচ বেড়ে যাবে।
এছাড়াও, নতুন ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই উচ্চ সুদহার ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ব্যবসায়িক খাতের বৃদ্ধির হার কিছুটা মন্থর হতে পারে। তবে, মূল্যস্ফীতি কমাতে এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত মুদ্রানীতি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে এবং এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আর্থিক খাতে এই ধরনের কঠোর নীতি গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাজারে বিভিন্ন প্রভাবও আসবে। ঋণের সুদহার বাড়লে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়িক খাতে নতুন ঋণ নেওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে ব্যবসায়িক খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে, যা স্বল্পমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, এই পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধির এই পদক্ষেপ মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গৃহীত একটি কঠোর আর্থিক নীতি। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাধারণ মানুষ ক্ষণিকের জন্য কিছুটা আর্থিক চাপে পড়তে পারেন, তবে এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি আনবে।