২২ অক্টোবর, মঙ্গলবার ভোরবেলা বুরাক এয়ারের একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে লিবিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৫৭ জন আটকে পড়া অনিয়মিত বাংলাদেশি। এদের বেশিরভাগই মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় ও সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার আশায় লিবিয়ায় পৌঁছান। তবে অবৈধ অভিবাসনের এই চেষ্টায় তাদের অনেকেই ভয়াবহ নির্যাতন, অপহরণ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েছেন।
ফেরত আসা এই বাংলাদেশিদের অধিকাংশই মানবপাচারকারীদের চক্রান্তের শিকার। তারা ভালো জীবনের আশায়, ইউরোপে গিয়ে কর্মসংস্থান ও সচ্ছলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে পাড়ি জমাতে ইচ্ছুক ছিলেন। মানবপাচারকারীরা তাদের এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে আশ্বস্ত করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের ফেলে আসা হয় লিবিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে।
লিবিয়ায় প্রবেশের পর তাদের বেশিরভাগই অপহরণের শিকার হন। লিবিয়ায় অপহরণ ও নির্যাতন এমন একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বিশেষত অনিয়মিত অভিবাসীরা প্রতিনিয়ত এর শিকার হন। কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়, এবং অনেক সময় শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদের দিন কাটাতে হয়।
এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহায়তায় অবশেষে লিবিয়া থেকে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন এই ১৫৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক। বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপলি ও আইওএম এর সহযোগিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। বিমানবন্দরে অবতরণের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইওএম-এর কর্মকর্তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানান।
আইওএম-এর পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসিত প্রত্যেককে নগদ ছয় হাজার টাকা, কিছু খাদ্য সামগ্রী, মেডিক্যাল চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও, তাদের সঠিক পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রত্যাবাসনের পরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই সমস্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। তারা সবাইকে আহ্বান করেন, যাতে এ ধরনের বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে কেউ ভবিষ্যতে লিবিয়া বা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা না করেন। কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ অভিবাসনের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে এবং তা শুধু ব্যক্তির জন্য নয়, বরং তার পরিবার ও সমাজের জন্যও বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনে।
এছাড়াও, সচেতনতার প্রচারাভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে কাজের সুযোগ, নিরাপদ অভিবাসন এবং সঠিক পথে বিদেশে যাওয়ার জন্য নানা ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
লিবিয়ায় নির্যাতন এবং অপহরণের শিকার হওয়া এই ১৫৭ জন বাংলাদেশিকে শুধুমাত্র দেশে ফিরিয়ে আনা নয়, তাদের সঠিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। মানবপাচারের শিকারদের জন্য আইওএম-এর মাধ্যমে বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রোগ্রাম এবং মেডিক্যাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এসব মানুষকে আবার নতুনভাবে জীবন শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে আর এই ধরনের বিপদের মুখোমুখি না হয়।
লিবিয়ায় এখনও অনেক বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক রয়েছেন। তাদের নিরাপদে দেশে ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপলি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইওএম একসাথে কাজ করছে। তাদের এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরও অনেককে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ সরকার এই ধরনের মানবপাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষত, বাংলাদেশি নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে নিয়মিত আলোচনা ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
লিবিয়া থেকে দেশে ফিরে আসা এই ১৫৭ বাংলাদেশি নাগরিকদের অভিজ্ঞতা শুধু তাদেরই নয়, বরং পুরো জাতির জন্য একটি বড় শিক্ষা। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টার পরিণতি কী হতে পারে, তা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশ সরকার, আইওএম এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টায় তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া যেমন চলছে, তেমনই ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এই পথে পা না বাড়ায়, সে ব্যাপারেও সচেতনতার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা মানবপাচার রোধে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের আরও কঠোর পদক্ষেপ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেয়।