৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান আসামি গ্রেপ্তার: র্যাবের সফল অভিযান
গাজীপুরে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীর হাতে স্ত্রী এবং শাশুড়িকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার একটি নৃশংস ঘটনার প্রধান আসামিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গত ২০ অক্টোবর র্যাব-১ এর সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এ হত্যাকাণ্ড পুরো দেশকে মর্মাহত করেছে এবং পারিবারিক সহিংসতার নৃশংসতা সম্পর্কে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তের নাম মো. রাহিল রানা ওরফে তানভীর (৩৫), যিনি টাঙ্গাইলের বরুহা গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে। ঘটনার শিকার হয়েছেন তার স্ত্রী মোরশেদা (২২) এবং শাশুড়ি মোছা. ফুলবানু (৪৫)।
গত ১৭ অক্টোবর গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার রতনপুর এলাকায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন রাতে অভিযুক্ত তানভীর ও আরও ২-৩ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে মোরশেদা ও তার মা ফুলবানুর বাসায় হামলা করে। তারা বাসার দরজায় গিয়ে জানায়, তারা মোরশেদার দুই বছরের মেয়ে রাইসাকে নিয়ে এসেছে এবং দরজা খুলতে বলে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তানভীর ও তার সহযোগীরা ঘরে প্রবেশ করে। তানভীরের হাতে থাকা বোতল ভর্তি পেট্রোল মোরশেদা এবং তার মা ফুলবানুর গায়ে ঢেলে দিয়ে জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর অভিযুক্তরা দরজা বাইরে থেকে আটকে পালিয়ে যায়।
ভিকটিমদের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালায়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত দগ্ধ হওয়ার কারণে চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং তারা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর গাজীপুরসহ সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই ভিকটিম ফুলবানুর মা আম্বিয়া বেগম (৬০) কালিয়াকৈর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার দায়েরের পর র্যাব-১ এর একটি বিশেষ টিম অভিযানে নামে। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। ২০ অক্টোবর, অভিযুক্ত মো. রাহিল রানা ওরফে তানভীরকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের বাসন থানার নাওজোড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তানভীর হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। র্যাব জানিয়েছে, তানভীরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা ঘটনার পেছনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছে। তার সহযোগী অন্যান্য আসামিদের ধরতে র্যাবের অভিযান চলমান আছে।
এই হত্যাকাণ্ড মূলত পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘটে। পারিবারিক কলহ থেকে এমন নৃশংস ঘটনার উদ্ভব হওয়া সমাজে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব যখন এমন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা পরিবার ও সমাজ উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা বা মনোমালিন্য যদি সময়মতো মীমাংসা না করা হয়, তা ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার আলোকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে যৌথভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, পারিবারিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য পরিবারগুলোর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। একইসঙ্গে আইনি সহায়তা প্রদান এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য দেশে বিভিন্ন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা রয়েছে। তবে সেই সেবাগুলোর প্রচার এবং সহজলভ্যতা বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে, পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের দ্রুত সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা এবং এই ধরনের ঘটনার তদন্ত ও বিচারের দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তানভীরের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাকে আদালতে হাজির করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে যে, তারা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে এবং তানভীর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য একটি বড় শিক্ষা। পারিবারিক কলহ বা সম্পর্কের টানাপোড়েন কখনোই সহিংসতার মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। পরিবারের মধ্যে সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে হবে। এই ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, সম্পর্কের মধ্যে বিদ্বেষ বা কলহ থাকা উচিত নয় এবং সহিংসতা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান নয়।
গাজীপুরে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড পারিবারিক কলহের এক চরম পরিণতি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সামাজিক সচেতনতা এবং আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারগুলোকে শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হতে হবে।