দেশে সবজির অস্বাভাবিক দামের অন্যতম কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই উঠে এসেছে সড়ক পথে পরিবহন খরচ ও পথে পথে চাঁদাবাজির বিষয়টি। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত সবজি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছানোর পথে পরিবহন সংকট, খরচ বৃদ্ধি, ও চাঁদাবাজির প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রেলওয়ে উদ্যোগ নিয়েছে সবজি পরিবহনে ট্রেনের ব্যবহার বৃদ্ধির। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সবজি বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের জন্য সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। রেল মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে অল্প খরচে, নিরাপদ এবং দ্রুত সবজি পরিবহন সম্ভব হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সবজি রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতে পরিবহনের জন্য মূলত সড়ক পথের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে যশোর অঞ্চল দেশের অন্যতম প্রধান সবজি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের সাতমাইল বারিনগর হাট থেকে প্রচুর সবজি ঢাকার বাজারে আসে। তবে সড়ক পথে পরিবহন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা উচ্চ পরিবহন খরচের সম্মুখীন হচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পথে পথে চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়ার কারণে পরিবহন খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে সবজির দামের ওপর।
যশোরের এক পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী বলেন, “যে ভাড়া দিয়ে আমরা ট্রাকভর্তি পণ্য আনছি, সে একই ভাড়া দিয়ে যদি অর্ধেক পণ্য নিই তাও খরচ সমান থাকে। কিন্তু ট্রেনে পণ্য পরিবহন করলে তা পণ্যের পরিমাণ অনুযায়ী হবে, যা খরচ কমাবে।”
অন্য আরেক ব্যবসায়ী বলেন, “ট্রেনে গেলে সড়কের যানজটের ঝামেলা থাকবে না, সময়ও বাঁচবে। এছাড়া পরিবহন খরচও সাশ্রয় হবে। এতে আমরা ব্যবসায়ীরাও লাভবান হব, আর ভোক্তারাও কম দামে সবজি কিনতে পারবে।”
বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, সবজির দাম নিয়ন্ত্রণে যাত্রীবাহী ট্রেনের সাথে লাগেজ ভ্যান সংযোজন করে সবজি পরিবহন শুরু করবে। রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে সপ্তাহে দু’দিন বিশেষভাবে সবজি পরিবহনের জন্য ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেসব ট্রেনে লাগেজ ভ্যান নেই, সেগুলোর সাথে অতিরিক্ত লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হবে, এবং কিছু ক্ষেত্রে নতুন ট্রেনও চালানো হবে। যশোর, খুলনা, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়সহ সবজি উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে এ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা হবে।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে সবজি পরিবহনের দাবি উঠেছে। স্থানীয় সবজি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ট্রেনের মাধ্যমে পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে এবং পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে পৌঁছানো যাবে। ট্রেনের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকরাও ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।
রেল মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগে কৃষক, ব্যবসায়ী, এবং সরকার সবার জন্যই সুবিধা আছে। কৃষকদের জন্য যশোর স্টেশনে অন্তত দুটি বগি বরাদ্দ করা উচিত বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার। এর ফলে কৃষকদের পরিবহন খরচ কমবে, যার ইতিবাচক প্রভাব রাজধানীর সবজির বাজারেও পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগে এই সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে সড়ক পথের চাঁদাবাজির সুযোগ কমে যাবে এবং সড়ক যানজট থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে। এর ফলে পণ্যের গুণগত মানও ঠিক থাকবে এবং সময় মতো বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যশোরের ব্যবসায়ীরা এ উদ্যোগের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, কারণ যশোর থেকে ঢাকার রেল যোগাযোগ ভালো এবং ট্রেনে পরিবহন করলে খরচ কমানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজির সুযোগও থাকবে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে সবজি পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ট্রেন এবং লাগেজ ভ্যান যোগ করার কাজ শুরু করেছি। বিশেষভাবে যশোর, খুলনা, বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ এবং পঞ্চগড়ের জন্য সবজি পরিবহনে ট্রেনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিটি ট্রেনে এক থেকে দুইটি লাগেজ ভ্যান যোগ করা হবে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে এই কাজ শুরু করতে পারবো।”
এছাড়া পণ্য লোড-আনলোডের খরচও কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করা হবে। রেল বিভাগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই রেল যোগাযোগ আছে এমন সবজি উৎপাদনকারী জেলাগুলোর ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে এবং সবাই এই উদ্যোগে আগ্রহী বলে জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে এ উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে ট্রেনে সবজি পরিবহনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ট্রেনের মাধ্যমে সবজি পরিবহন একটি সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। সড়ক পথে পরিবহনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতে ট্রেন পরিবহন হতে পারে অন্যতম কার্যকর পন্থা। এর ফলে কৃষক, ব্যবসায়ী, এবং ভোক্তারা প্রত্যেকেই সুবিধা পাবে। সরকারের এ উদ্যোগ সফল হলে দেশের খাদ্য বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।