সদ্য ৪৪ বছর পর পুনরায় পানিপথে হজযাত্রার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হজযাত্রীদের খরচ কমানো এবং একটি প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা। বর্তমানে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এবং সৌদি আরবের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সমুদ্রপথে হজযাত্রার ইতিহাস বহু প্রাচীন। সুলতানি আমল থেকেই পালতোলা জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রীদের মক্কা-মদিনায় যাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। ইতিহাস অনুযায়ী, ১২০৪ সালে এই যাত্রার গোড়াপত্তন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সর্বশেষ সমুদ্রপথে হজযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময়ে “হিজবুল বাহার” নামের জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রীরা যাত্রা করতেন। এরপর এরশাদের শাসনামলে আকাশপথে হজযাত্রীদের প্রেরণ শুরু হলে সমুদ্রপথে যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন পর আবারও সমুদ্রপথে হজযাত্রী প্রেরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো হজযাত্রীদের জন্য খরচ কমানো। বর্তমান পরিস্থিতিতে আকাশপথে হজযাত্রার খরচ অনেক বেশি, যা সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানিপথে হজযাত্রা হলে খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক প্রচলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাচ্ছে।
গত ৬ অক্টোবর ২০২৪, সৌদি আরবের জেদ্দায় সৌদি হজ ও উমরাহ বিষয়ক মন্ত্রী ড. তাওফিক ফাউযান আল রাবিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনের বৈঠকে পানিপথে হজযাত্রার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সৌদি হজ ও উমরাহ মন্ত্রী প্রাথমিকভাবে এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। সৌদি সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর বাংলাদেশকে জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।
যদিও পানিপথে হজযাত্রার খরচ কম হবে, তবে দীর্ঘ সময় এবং নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের কারণে আগের সরকারগুলি এই উদ্যোগ গ্রহণে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বর্তমানে আকাশপথের দ্রুততার সঙ্গে তুলনা করলে সমুদ্রপথের যাত্রা অনেক দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। যদিও পূর্বে যাত্রা করতে এবং ফিরে আসতে ১৪ দিন করে মোট ২৮ দিন সময় লাগত, বর্তমানে আধুনিক জাহাজ ব্যবহারের ফলে এই সময় কমে প্রায় ১৬ দিন হতে পারে। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে দীর্ঘসময়ের যাত্রা হজযাত্রীদের জন্য ক্লান্তিকর হতে পারে। এ ছাড়াও, বন্দর ব্যবস্থাপনা, জাহাজ প্রস্তুতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলিতে দক্ষতা প্রয়োজন, যা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত করা যায়নি।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের হজযাত্রার জন্য পানিপথে হজযাত্রী প্রেরণ সম্ভব হবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। যদিও ইতোমধ্যেই সৌদি আরব সরকারকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং প্রাথমিক সম্মতি পাওয়া গেছে, পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে অনেকগুলো ধাপ সম্পন্ন করতে হবে। এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে দুই-তিন হাজার হজযাত্রী জাহাজযোগে পাঠানোর চিন্তাভাবনা চলছে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন না হলে এ বছর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
২০২৫ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে পবিত্র হজ পালিত হবে। এবছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী মক্কায় যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। হজ নিবন্ধন প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং এটি চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। যেসব হজযাত্রী জাহাজে করে হজে যেতে ইচ্ছুক, তাদের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায়, তারা আকাশপথে হজযাত্রার জন্য বাধ্য হবেন।
এছাড়াও, সৌদি সরকারের নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী মিনা ও আরাফায় তাঁবু বরাদ্দসহ অন্যান্য কার্যক্রম ২৩ অক্টোবরের মধ্যেই শেষ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না হলে হজযাত্রীদের দূরের এলাকা বা নিউ মিনা অঞ্চলে তাঁবু নিতে হতে পারে, যা হজযাত্রীদের জন্য অস্বস্তিকর হবে।
যদি পানিপথে হজযাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের জন্য এটি হবে একটি বড় ধরণের সাশ্রয়ী মাধ্যম। আকাশপথের তুলনায় পানিপথে যাত্রা করলে খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাবে। যাওয়া-আসায় আট দিন করে ১৬ দিন এবং হজ পালনসহ মোট এক মাস সময় লাগতে পারে। সৌদি আরব সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলে ২০২৫ সালের হজচুক্তিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সমুদ্রপথে হজযাত্রার এই উদ্যোগ যদি সফল হয়, তবে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে এবং ভবিষ্যতে হজযাত্রার ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।