সেন্টমার্টিন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ, যা ‘নারকেল জিঞ্জিরা’ নামেও পরিচিত, প্রতিবছর পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। পর্যটন মৌসুম শুরু হলেও ২০২৪ সালের মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চালু হয়নি। এই বিলম্বের ফলে পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ রয়েছে, যা দ্বীপের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবিকা সংকটে ফেলছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে অনৈতিক আয় বৃদ্ধির আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন।
সেন্টমার্টিনের অর্থনীতি মূলত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। দ্বীপে পর্যটন মৌসুমের শুরু থেকেই এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসতে শুরু করে। এতে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটক গাইড এবং ছোট-বড় দোকানগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তবে ২০২৪ সালে এখনো পর্যটকদের যাতায়াতের সুযোগ না থাকায় দ্বীপের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে। দ্বীপের এক লাখেরও বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাত; এর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে।
টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল না করায় পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও তাদের ব্যবসা মন্দার দিকে যাচ্ছে। বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থা ভয়াবহ, কারণ তারা পর্যটন বন্ধ থাকায় বিকল্প আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন না। এর ফলে বেকারত্ব বাড়ছে এবং জীবিকার সংকট তৈরি হচ্ছে।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা দ্রুত জাহাজ চলাচল চালুর দাবি জানাচ্ছেন। তাদের মতে, পর্যটন বন্ধ থাকলে বেকারত্বের হার বাড়বে এবং মানুষ অনৈতিক ও অবৈধ আয় বৃদ্ধির পথে ঝুঁকতে বাধ্য হবে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চালুর দাবিতে সম্প্রতি একটি মানববন্ধন এবং স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। মানববন্ধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বৈধপথ বন্ধ হয়ে গেলে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা বিকল্প আয় খুঁজবে, যার মধ্যে অনেকেই অবৈধ আয়ের দিকে ঝুঁকবে।’
সেন্টমার্টিন পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীরা গত কয়েক বছর ধরে মন্দার মুখোমুখি হচ্ছেন। সেন্টমার্টিন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের একজন, মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘এখানে ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু পর্যটন বন্ধ থাকায় তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। দীর্ঘ মেয়াদে পর্যটন বন্ধ থাকলে দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি ধসের মুখে পড়বে।’
দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা নিয়ে সরকারের কঠোর নিয়ম এবং রাত্রিযাপন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। যদিও পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন, কিন্তু এর মাধ্যমে পর্যটন বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন। স্থানীয়রা বলছেন, পরিবেশ রক্ষা এবং পর্যটনের উন্নয়ন একসাথে করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পর্যটন খাত চালু রেখে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে তারা মতামত প্রকাশ করেছেন।
সেন্টমার্টিনে রাতযাপন নিষেধাজ্ঞা এবং পর্যটকদের যাতায়াতের সুযোগ সীমিত করার ফলে দ্বীপের পর্যটন খাত প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। দ্বীপের হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাতে পর্যটক থাকার অনুমতি না থাকায় তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন দ্বীপের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা। তাদের মতে, পর্যটন খাত চালু থাকলে দ্বীপের মানুষ বৈধ আয়ের সুযোগ পাবে এবং বেকারত্ব কমবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী জানান, ‘স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা পর্যটকবাহী জাহাজ চালুর বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’
পর্যটন বন্ধ থাকায় দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের সুযোগ না থাকায় তারা অবৈধ আয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকট মানুষের অনৈতিক পথে যেতে বাধ্য করতে পারে বলে স্থানীয়দের শঙ্কা। কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘পর্যটন ব্যবসায় ধস নামলে সীমান্ত এলাকার মানুষ আরো অসহায় হয়ে পড়বে এবং অবৈধ আয় বাড়তে পারে।’ এ পরিস্থিতি এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা।
সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাত পুনরায় সচল করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, পর্যটকদের জন্য টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল চালু করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, দ্বীপের রাত্রিযাপনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া প্রয়োজন, যাতে পর্যটকরা রাত কাটানোর সুযোগ পায় এবং দ্বীপের হোটেল-মোটেল ব্যবসা চাঙা হয়।
এছাড়া, পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকারের নির্দেশনাগুলো কার্যকরভাবে পালন করতে হবে। পর্যটকদের জন্য সঠিক নির্দেশনা ও নিয়মাবলী জারি করে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন খাতও চালু রাখা সম্ভব। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, সঠিকভাবে পর্যটন খাত পরিচালনা করলে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও সম্ভব।
সেন্টমার্টিনে পর্যটন বন্ধ থাকার ফলে দ্বীপের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটে পড়েছে। পর্যটনসংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বৈধ উপায়ে আয় করতে না পারলে বেকার মানুষরা অবৈধ পথে ঝুঁকে পড়তে পারে, যা সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত জাহাজ চলাচল ও রাত্রিযাপন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পর্যটন খাতকে চাঙা করা।